মন্তব্য প্রতিবেদন

তৌকিরের মৃত্যু! কে দিবে শত প্রশ্নের জবাব?

বিমান বিধ্বস্ত

"তিনি আকাশে মারা যাননি… তিনি মরে গিয়েছিলেন অনেক আগেই।"
নাম তার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম। নব্য বিবাহিত — ঘরে নতুন বউ, দেয়ালে ঝুলছে বিয়ের ফ্রেম করা ছবি, মা হয়তো দোয়া পড়ে পাঞ্জেরি রেখেছেন ওড়নার কোণায়। আজ সকালেও হয়তো চা খাওয়ার সময় স্ত্রী বলেছিল, “ফিরে এসো ঠিকঠাক মতো, বিকেলে একসাথে বাজারে যাব।”

কিন্তু তিনি ফিরলেন না।

আজ তৌকিরের হাতে ছিল একটা বোতাম — যেটা টিপলেই সে ছিটকে পড়তে পারতো আকাশ থেকে নিরাপদে। ফিরে যেতে পারতো বাড়ি, স্ত্রী, পরিবার, জীবন—সবকিছুর কাছে। আল্লাহর কাছে সেজদায় লুটিয়ে বলতো, “আপনি আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন!”

জরুরি পরিস্থিতিতে প্রাণ রক্ষায় বিমানের নিয়ন্ত্রণ সিট ত্যাগ করে প্যারাসুট নিয়ে লাফ দিলেই সে ফিরে যেতে পারতেন পরিবারের কাছে, জীবনের কাছে। কিন্ত তৌকির তা করেন নি।

তিনি সেই বোতাম চাপলেন না।

তৌকির জানতেন — তার নিচে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহর। মেট্রোরেল, ভবনের পর ভবন… একটা ভুলে শত শত প্রাণ নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে।

তবুও, নিজের জীবন বাজি রেখে, তিনি বিমানটিকে টানলেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। চেয়েছিলেন যেন আর কারও গায়ে আঁচ না লাগে।

কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। বিমানটি ছিটকে পড়লো রাজধানীর উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর। 
নিয়তির কি নির্মমতা — তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও, তার হাত ধরেই চলে গেলো আরও কিছু তাজা প্রাণ। বাচ্চারা… যারা স্কুলে ছিল, ক্লাসে ছিল, স্বপ্নে ছিল।
তাহলে এটা কি নিচকই কোনো দুর্ঘটনা?

কারণ সাহসী তৌকিরের এ মৃত্যু কেবল একজন অকুতোভয় অফিসারের মৃত্যুই নয়। না। এটা ব্যর্থতা। এটা দুর্নীতি। এটা একটা রাষ্ট্রীয় খুন।
খুন এজন্যই যে তার এ মৃত্যু নানান প্রশ্নেরও জন্ম দিয়ে গেছে। 

এমন একটি পুরানো মডেলের বিমান এখন আকাশে ওড়ার কথা নয়। তবু সেটিই উড়ছিল। কারণ দুর্নীতি এখনও উড়ছে এই দেশের আকাশে। আর সেই দুর্নীতির ভার বইছে এই প্রজন্মের সাহসীরা।

তৌকির আকাশে মারা যাননি। তিনি মরে গিয়েছিলেন অনেক আগেই— যেদিন বাজেট চুরি হয়েছিল, যেদিন সিদ্ধান্ত হয়েছিল ১৯৬৬ সালের বাতিল বিমান দিয়েই চলবে আধুনিক যুগের প্রশিক্ষণ।

এই সিস্টেম তাঁর জন্য কিছুই রাখেনি— না কোনো নিরাপত্তা, না কোনো বিকল্প। রেখে গেছে কেবল ঝুঁকি, মরচে ধরা লোহা, আর এক তরুণ অফিসারের নিশ্চিত মৃত্যু।

এমন একটি পুরনো F-7 বিমান, যেটা চীনে এখন জাদুঘরে টাঙানো হয়, বাংলাদেশে সেটা উড়ছে — কারণ আমাদের বাজেট চুরি হয়, নতুন বিমানের বরাদ্দ যায় বিলাসবহুল গাড়ি আর কমিশনে।

তৌকির মারা যাননি আজ। তিনি মরে গিয়েছিলেন সেই দিন— যেদিন তাঁকে দেওয়া হয়েছিল পুরনো লোহা আর বিপজ্জনক দায়িত্ব, সেই বাজেট চুরির দিনে, যেদিন যুদ্ধের নামে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল ভাঙা খেলনা।
আজ শুধু একজন পাইলট নয়, নিচে থাকা শিশুদের মৃত্যুও দুর্নীতির মাশুল। তাদের বাবা-মা আজ কাঁদছেন, কিন্তু এই কান্না পৌঁছাবে না কোনো হিমশীতল অফিস ঘরে।
কারণ এখানে তদন্ত হয়, দায়ভার হয় না। প্রেস রিলিজ হয়, বিচার হয় না। মোমবাতি জ্বলে, দায়ী কেউ জেলে যায় না।
আমরা ভুলে যাব না। আমরা চুপ থাকব না। এই মৃত্যু আমাদের জাগিয়ে তুলবে — যতক্ষণ না আমরা বলি, “এই রাষ্ট্র শুধু শোক চায় না, জবাবদিহি চায়।

জবাবদিহি এজন্যই প্রয়োজন- তৌকির যে বিমানটি চালাচ্ছিলেন সেটি ছিল F-7 পুরনো একটা যুদ্ধবিমান। ১৯৬৬ সালে তৈরি করা বিমান, যার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে ২০১৩ সালে। যেটা এখন সারা বিশ্বে 'ফ্লাইং কফিন' নামেই পরিচিত। এই টাইপের একটা ফাইটার প্লেন এখনো বাংলাদেশের মেইন ফাইটার!

উত্তরায় বিমান বিধ্বস্তের এই ভয়াবহ ঘটনায় শুধু তৌকির নন, প্রাণ হারিয়েছেন আরও অনেকে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মোট ১৯ জনের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মিডিয়া সেলের সিনিয়র স্টাফ অফিসার মো. শাহজাহান শিকদার। সোমবার (২১ জুলাই) বিকেলে সন্ধ্যায় এ তথ্য জানান।

তিনি জানান, ৯টি ইউনিট ও ৬টি অ্যাম্বুলেন্স কাজ করছে। উদ্ধার কাজ এখনো চলমান আছে।

এদিকে, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ৫০ জনের বেশি দগ্ধ হয়েছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। তারা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।

প্রসঙ্গত, সোমবার দুপুর ১টার পর রাজধানীর উত্তরায় দুর্ঘটনায় পড়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান। বিমানটি উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে গিয়ে পড়ে এবং বিধ্বস্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বিমান ও স্কুল ভবনটিতে আগুন ধরে যায়। যে ভবনে এটি বিধ্বস্ত হয় সেখানে বহু স্কুল শিক্ষার্থী ছিল বলে জানা গেছে। যাদের বেশিরভাগই হতাহত হয়েছে।

বাংলাকন্ঠ পরিবার ভয়াবহ এ দূর্ঘটনায় গভীরভাবে শোকাহত। আমরা নিহত সবার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। বিশেষ করে নিহত এবং আহতদের পরিবার-পরিজনের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাই। মহান আল্লাহ যেন আহতদের দ্রুত সুস্থতা দান করেন এবং নিহতদের স্বজনরা যেন এ শোক কাটিয়ে উঠতে পারে। 
তবে একই সঙ্গে আর যেন কোনো তরুণ তৌকিরকে একটা মরচে ধরা বিমানের সঙ্গে জীবন বিসর্জন দিতে না হয় সেই প্রত্যাশাও রইল।