
আর্থিক খাতের যে হাল
- ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১২:১৬

ব্যাংক খাতে লুটপাট, অর্থ পাচার, শেয়ারবাজার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অস্থিতিশীলতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপসহ নানা কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে অর্থনীতি চরম সংকটে পড়ে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনে—মূল্যস্ফীতির চাপে জনজীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতনের পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এই বেহাল অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা। পর্যবেক্ষকদের মতে, আর্থিক খাত সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপগুলো সবচেয়ে সফল হয়েছে। বিশেষ করে ভেঙে পড়া ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে।
দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংক খাতসহ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নানা উদ্যোগ নেয় সরকার। ব্যাংকিং আইন সংশোধন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান, রেমিট্যান্সের রেকর্ড সংগ্রহ, ডলারসংকট দূর হওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস এবং তারল্যসংকট সমাধানের মতো বিভিন্ন পদক্ষেপে অর্থনীতিতে স্বস্তি এসেছে।
নথিপত্র বলছে, দেশের দ্রুত কমে আসা রিজার্ভ গত এক বছরে তরতরিয়ে বাড়ছে। এর নেপথ্যে মূল অবদান প্রবাসীদের। তাঁরা রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে একের পর এক রেকর্ড ভেঙেছেন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রিজার্ভ এসেছে ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরে তা ছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার রিজার্ভ ছিল ৩০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ২ আগস্ট রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ পদক্ষেপে ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে ঘাটতি থেকে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৯৮ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চলতি ঘাটতি ছিল ৬৫১ কোটি ডলার। গত জুন শেষে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত হয়েছে ৩২৯ কোটি ডলার।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ ছিল। সরকার বদল হওয়ায় প্রকৃত হিসাব প্রকাশ পাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের শুরুতে ১০টির বেশি ব্যাংক, ১৫টির মতো নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) এবং কিছু বিমা কোম্পানি গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। টাকার হাহাকার রোধের স্বার্থে ব্যাংকগুলোকে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ধার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সঞ্চয়ের টাকা ফেরত দিতে গত ৩০ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেয়। এর মাধ্যমে গ্রাহক সঞ্চয়ের কমপক্ষে ২ লাখ এবং সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা ফেরত পাবেন। আগে কোটি টাকার আমানতধারীও ফেরত পেতেন সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা। ব্যাংককে দেওয়ার জন্য টাকা ছাপানো হবে না বলেও দেওয়া অঙ্গীকারটি অবশ্য রাখতে পারেনি সরকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সুবাদে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। সম্প্রতি ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার ১০ শতাংশ রাখা হয়েছে। গত বছর একই সময়ে তা ছিল ৯ শতাংশ। চলতি বছরের জুলাইয়ে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত বছরের আগস্টে তা ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
ব্যাংক খাত ঢেলে সাজাতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ডজনখানেক ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এস আলমের যথেচ্ছাচারে বিপর্যস্ত দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। ব্যাংকটি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। ব্যাংকিং আইন সংশোধন করা হয়েছে। পরিচালকদের মতামত গোপন করায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে শত শত খেলাপির বন্ধকি সম্পদ ব্যাপকহারে নিলামে তোলা হচ্ছে। রাজনৈতিক পালাবদলে লুকানো খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় তা হু হু করে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকায়।
খেলাপি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণের মেয়াদ পার হওয়ার মাত্র ৯০ দিনে তা খেলাপি দেখাতে বলা হয়েছে। আগে মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে কৌশলে ২১ বছর পর্যন্ত ঋণ পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করা যেত। ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) সার্ভারে খেলাপির তথ্য হালনাগাদের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাত থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিতে যাচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) অযাচিত ক্ষমতা কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিসেম্বরে স্বাধীন ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকাশিত শ্বেতপত্রের হিসাব অনুযায়ী শেখ হাসিনার দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন (২৮ লাখ কোটি টাকা) ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর নাগরিক সমাজের তরফ থেকে পাচারের অর্থ ফেরত আনার দাবি ওঠে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিষয়টি মোটেই সহজ হবে না। পাচারের অর্থ ফেরাতে এ পর্যন্ত ৯টি দেশকে চিঠি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সূত্রে বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা কিছু ব্যক্তির অর্থ লেনদেনে নিষেধাজ্ঞার ঘটনা ঘটেছে।
এ বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘পাচার করা অর্থ ফেরত আনার সহজ কোনো রাস্তা নেই। কারণ, পাচার হওয়া অর্থের যোগসূত্র প্রমাণ করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।’