আস্থা ফিরছে পুঁজিবাজারে

পুঁজিবাজার

দীর্ঘদিন ধরেই পুঁজিবাজারে বিরাজ করছিল অস্থিরতা। এর মধ্যে গত বছরের এই সময়ে অস্থিরতার মধ্যে দায়িত্ব নেয় শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের প্রধান অঙ্গীকার ছিল দেশের ভেঙে পড়া সব খাতে সংস্কার করা। এরই ধারাবাহিকতায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনেও (বিএসইসি) সংস্কার করা হয়। ইতিবাচক বার্তা নিয়ে সংস্থাটির পুরো কমিশনে আসে পরিবর্তন। যদিও তার প্রতিফলন দেখতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তবু শেষদিকে এসে স্বস্তি ফিরেছে বিনিয়োগকারীসহ পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মনে। তবে এই স্বস্তি কতদিন স্থায়ী হয় এটা নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।

গত বছরের ১৮ আগস্ট খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর, আগের কমিশনের ফেলে রাখা বিভিন্ন বিষয় পুনরায় খতিয়ে দেখা শুরু করে। এর অংশ হিসেবে, পূর্ববর্তী সময়ে বড় অঙ্কের জরিমানার উপযুক্ত হলেও যেসব প্রতিষ্ঠানে নামমাত্র জরিমানা করা হয়েছিল বা কোনো জরিমানা না করেই বিষয়গুলো ফেলে রাখা হয়েছিল, সেসব ফাইল আবারও খোলা হয় এবং বর্তমান কমিশন সেসব প্রতিষ্ঠানে বড় অঙ্কের জরিমানা আরোপ করে।

পরবর্তীতে, বিভিন্ন কোম্পানিকে 'জেড' ক্যাটাগরিতে পাঠানোর সিদ্ধান্তসহ একের পর এক ‘পুঁজিবাজার সংস্কার’মুখী পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দেয় এবং বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমান্বয়ে লেনদেনের পরিমাণ কমতে কমতে দৈনিক মাত্র ২০০ কোটি টাকায় নেমে আসে, যা বাজারের জন্য ছিল এক করুণ চিত্র।

এর ফলে বেশ কিছু ব্রোকারেজ হাউস বিপদে পড়ে কর্মী ছাঁটাই করতে হয় এবং কয়েকটি শাখা অফিসও বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা বিএসইসি চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগের দাবিতে সড়কে নামেন এবং তা পর্যায়ক্রমে নিয়মিত প্রতিবাদে রূপ নেয়।

এক পর্যায়ে অর্থ উপদেষ্টা থেকে শুরু করে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী এমনকি প্রধান উপদেষ্টা পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর করা হয় বাজারের করুণ অবস্থার। পরবর্তী সময়ে বিএসইসি চেয়ারম্যানকে নিয়ে একটি বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে তিনি পুঁজিবাজারের উন্নয়নে পাঁচটি নির্দেশনা দেন। এর পরও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফেরেনি। এছাড়া মাঝে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধও দেশের পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এরপর চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক এমন বেশকিছু সুযোগ আসার পর থেকে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চাঙ্গাভাব ফিরতে শুরু করে। এছাড়া যখন নির্বাচনের ডামাডোল বাজতে শুরু করল, তখন পুরোপুরিভাবে আস্থা আসে বিনিয়োগকারীদের মনে। শেষে দুই মাস ধরে পুঁজিবাজারে প্রাণ ফিরে আসে। দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ওঠে হাজার কোটির ঘরে। এছাড়া সূচকও বাড়তে থাকে বড় অঙ্কে। তবে এ পর্যন্ত আসতে নিঃস্ব হয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী।

এক বছরে কমেছে দৈনিক গড় লেনদেন: দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে নেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারে পতনের পর ৮ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ৮ আগস্ট পর্যন্ত ২৩৯ কর্মদিবসে লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আলোচিত সময়ে গড়ে দৈনিক লেনদেন হয়েছে ৪৯২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট পর্যন্ত ২৩৭ কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছিল ১ লাখ ৪৪ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। সে সময়ে দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ৬১১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে লেনদেন কমেছে প্রায় ২৭ হাজার ৩২১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। দৈনিক গড় লেনদেন কমেছে ১১৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

কমেছে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা: ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) এক সদস্য বলেন, সূচক আমাদের কাছে প্রধান নয়। এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে লেনদেন। কয়েকদিন ধরে লেনদেন বাড়তে শুরু করেছে। মাঝে দীর্ঘ একটা সময় বাজারের খুব করুণ অবস্থা ছিল। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমেছে। আমার হাউসে আগে ১৬ হাজার গ্রাহক ছিল; কিন্তু এখন তা কমে নেমেছে তিন হাজারের ঘরে। প্রতিদিন ১০০ জন বিনিয়োগকারী লেনদেনে অংশ নেন না। যারা আছেন, তাদের অর্ধেকের বেশি বিনিয়োগ করার মতো টাকা নেই।

এক বছরের ব্যবধানে কমেছে সূচক: ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ৯২৪ পয়েন্ট, যা ২০২৫ সালের ১০ আগস্ট এসে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৫১ পয়েন্টে। অর্থাৎ এক বছরে সূচক কমেছে ৫৭৩ পয়েন্ট বা ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

বেড়েছে মূলধন: ডিএসইতে এক বছরের ব্যবধানে যদিও লেনদেন ও সূচক কমেছে; তবে এরই মধ্যে বাজারের মোট মূলধন কিছুটা বেড়েছে। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৩ হাজার ৯১৩ কোটি ৮ লাখ টাকা। ২০২৫ সালের ১০ আগস্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ১২ হাজার ৯৪০ কোটি ৮ লাখ টাকায়। অর্থাৎ এক বছরে মূলধন বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ হাজার ২৭ কোটি টাকা।

বিআরবি সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, মাঝের সময়টা একদমই বাজার খারাপ গেছে। এর মধ্যে ইরান-ইসরায়েল, পাকিস্তান-ভারত সংঘাত, যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কারোপ, রাজনৈতিক অস্থিরতা সব মিলিয়ে খুব কঠিন সময় পার করেছে দেশের পুঁজিবাজার। তার মধ্যেও এখন বাজার ইতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে। দেখা যাক এই ইতিবাচকতা কয়দিন ধরে রাখা যায়।