কী চলছে শিক্ষাঙ্গনে?

শিক্ষাঙ্গন

২০২৪ সালের জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষাঙ্গনে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। ছাত্র-জনতার টানা ৩৬ দিনের সেই আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার, আর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও নানা ঘটনায় আলোচনায় থেকেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন।

গত এক বছরে অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকসহ প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষক নিজেদের শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত আড়াই হাজার শিক্ষককে মব করে প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ, দাবিদাওয়ায় সড়ক অবরোধ, শিক্ষকদের শারীরিক লাঞ্ছনা এবং টানা আন্দোলনের কারণে সারাদেশের শিক্ষাঙ্গন উত্তাল ছিল। এর প্রভাব পৌঁছেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও।

এরই মধ্যে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রামসহ দেশের অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ায় যেকোনো ইস্যুতেই দ্রুত আন্দোলনে নামছেন, যা শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে।

গত এক বছরে দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্তত ২৬টি সংঘর্ষ, নয়টি আন্দোলন এবং তিনটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বিভিন্ন দাবিতে অন্তত ১২০টি আন্দোলন করেছে দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল কলেজগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরাই তুচ্ছ ঘটনায় ১৫ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। গত এক বছরে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল শিক্ষার্থীদের সচিবালয়ে ঢুকে ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করানো এবং সেগুলোতে অটোপাস আদায় করা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালেও পরীক্ষায় অটোপাস চায় শিক্ষার্থীরা, যদিও সরকার তাতে সায় দেয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাবলিক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের পদত্যাগে চাপ তৈরি হয়। কেউ পদত্যাগ করতে না চাইলে তাকে নির্যাতন ও অপমান করা হয়। শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করানোর এসব ঘটনা রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিলেও এ অবস্থা চলেছে প্রায় বছরজুড়েই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাঠামো। এখনো অনেক শিক্ষক কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে মারামারি, শিক্ষকদের আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সংঘর্ষ, শিক্ষার্থীরা সময়মতো বই হাতে না পাওয়াসহ নানা ঘটনায় শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সাত কলেজ নিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রাজধানী ছিল উত্তাল। ঢাকার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে ভাঙচুরসহ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ ছিল অন্যতম আলোচিত ঘটনা।

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংঘর্ষের জেরে ৩৭ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার ইস্যুতে উত্তপ্ত হয় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ৩৭ শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়, অপসারিত হন উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যও। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে মে মাসে সরিয়ে দেওয়া হয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শুচিতা শরমিন, সহ-উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম রব্বানী এবং কোষাধ্যক্ষ মো. মামুন অর রশিদকে।

সর্বশেষ গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কয়েকটি ইস্যুতে ফের উত্তপ্ত দেশের শিক্ষাঙ্গন। বিভিন্ন ইস্যুতে অন্তত ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর মধ্যে স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ থামাতে ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুদিনের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ অন্তত ১৮০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এ ঘটনায় তাদের পক্ষের আহত হয়েছেন ১০ থেকে ১২ জন। এ ঘটনার জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

এর বাইরে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানজুড়ে সংঘর্ষ, অবরোধ ও আন্দোলনের ঝড় বইছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসু নির্বাচন ঘিরে তুলকালাম, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনশন-হুঁশিয়ারি, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেলপথ অবরোধ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সর্বাত্মক শাটডাউনসহ শিক্ষক সংগঠনের মহাসমাবেশে একাধিক দাবিতে সরব শিক্ষাঙ্গন। এমন পরিস্থিতিতে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তহীনতায় পরিস্থিতি ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে—এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

গতকাল রাতে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় বাকৃবি শিক্ষার্থীরা। রাত সাড়ে ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষ চলছিল। এর আগে কম্বাইন্ড (সমন্বিত) ডিগ্রির দাবি পূরণ না হওয়ায় বাকৃবি উপাচার্যসহ দুই শতাধিক শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে রাখে টি অনুষদের শিক্ষার্থীরা। রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত শিক্ষকেরা অবরুদ্ধ ছিলেন। এর আগে দিনে দুবার ট্রেন অবরোধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থীরা।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ১৫০ একর জমি অধিগ্রহণ, পরিবহন সংস্কার এবং তিন মাসের মধ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডির সব কাজ সম্পন্ন করার দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি মেনে না নিলে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আমিনুল ইসলাম, ববি শাখার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক আহ্বায়ক রাকিব আহমেদ এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের শাখা সংগঠক।

এক সপ্তাহ ধরে মাঠের আন্দোলনে বিএসসি (স্নাতক) ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা। বিএসসি (স্নাতক) প্রকৌশলীরা ঢাকা ও জেলা শহরের কলেজ চত্বরে সমাবেশ ছাড়াও বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। আন্দোলনের জেরে বুয়েটসহ কয়েকটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। অচলাবস্থা বিরাজ করছে বিভিন্ন পলিটেকনিক প্রতিষ্ঠানেও।

বিভিন্ন সময়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে আলোচনায় থাকা ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা চলতি মাসেও সংঘর্ষ-হাতাহাতিতে জড়িয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও বিএম কলেজ, যাত্রাবাড়ীতে তিন কলেজ, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এবং চট্টগ্রাম কলেজসহ বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও গত এক বছরে বিভিন্ন সময়ে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন।

গত এক বছরে প্রাথমিক থেকে ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন বৈষম্য নিরসন, এমপিওভুক্তি, চাকরি জাতীয়করণ, বদলি নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং পেনশন স্কিমসহ বিভিন্ন দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। এ সময় সমাবেশ, কর্মবিরতি, অনশন থেকে শুরু করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।

বেতন স্কেলে ১১তম গ্রেডের দাবিতে কয়েক দফা কর্মসূচি শেষে সম্প্রতি প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক ঐক্য পরিষদ ২৬ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে। গত শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহাসমাবেশ থেকে সংগঠনের নেতারা হুঁশিয়ারি দেন, দাবি পূরণ না হলে ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে আমরণ অনশন শুরু হবে।

এমপিওভুক্তির দাবিতে বেসরকারি শিক্ষকরা গত এক বছরে একাধিক কর্মসূচি পালন করেছেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তারা উৎসব ভাতা ২৫ শতাংশ বৃদ্ধিসহ বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও শ্রান্তি- বিনোদন ভাতা কার্যকরের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে টানা ২২ দিন অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। জানুয়ারিতে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে শাহবাগে মিছিল করলে পুলিশের হামলার শিকার হন। তবে পরে তাদের দাবি সরকার মেনে নেয়।

এছাড়া জুনে ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার ভাইভার ফলে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে অনুত্তীর্ণ প্রার্থীরা আন্দোলনে নামেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তাদের বিক্ষোভে পুলিশ জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে। একই মাসে জাতীয়করণের আওতা থেকে বাদ পড়া প্রায় পাঁচ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা ছত্রভঙ্গ করে।

এপ্রিলে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা বাস্তবায়নের দাবিতে বাংলাদেশ টিচার্স সোসাইটি (বিটিএস) মানববন্ধন ও কর্মসূচির ডাক দেয়। অন্যদিকে, গত ৫ আগস্টের পর বেসরকারি স্কুল ও কলেজ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া শিক্ষকরা পুনর্বহাল এবং নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদানের দাবিতে একাধিক আন্দোলন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতার পেছনে অন্যতম কারণ গত এক বছরেও শিক্ষার্থীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি। শিক্ষার বিরাজমান সমস্যা নিরসনে শিক্ষা কমিশন গঠন তো দূরের কথা, বিপ্লব করা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের পথ দেখাবে—এমন কোনো নির্দেশনাও সরকারের পক্ষ থেকে ছিল না। নির্বাচন নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দল যতটা তৎপর, তার বিন্দুমাত্র তৎপরতা শিক্ষা খাতে দেখালে এত আন্দোলন হতো না।