
প্রধান উপদেষ্টাকে আদানির ‘তাগাদা’
- ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:৪৫

ভারতের আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি প্রধান উপদেষ্টার কাছে চিঠি পাঠিয়ে বকেয়া টাকা দ্রুত পরিশোধের জন্য হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। এটি প্রথমবারের মতো পাঠানো চিঠি, যেখানে বকেয়া আদায়ে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আদানি গ্রুপ জানিয়েছে, বকেয়া পরিশোধে দেরি হওয়ার কারণে বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঋণদাতা ও অংশীদারদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
চিঠি প্রাপ্তির পর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর এটি বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠিয়েছে। বর্তমানে আদানির বকেয়া বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫,৭০৭ কোটি টাকা (৪৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। বিদ্যুৎ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আদানির বকেয়া পরিশোধ নিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাইয়ে আদানির সব পূর্ববর্তী বকেয়া পরিশোধ করা হয়। এর আগে, চলতি বছরের জুনে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৪৩৭ মিলিয়ন ডলার একসাথে পরিশোধ করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশ থেকে আদানির সবচেয়ে বড় এককালীন অর্থপ্রাপ্তি হিসেবে রেকর্ডভুক্ত। তার আগে, এই কোম্পানিটি মাসে গড়ে ৯০–১০০ মিলিয়ন ডলার বিদ্যুতের বিল হিসেবে পেত।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন যে বকেয়া জমা হয়েছে, তা লেটেস্ট। এর আগে এই বছরেই একসঙ্গে সব বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছিল। এখন বকেয়া পরিশোধের বিষয়টি নিয়ে পিডিবি কাজ করছে। এটা নীতিগত কোনো বিষয় নয়। এন্টারপ্রাইজ লেভেলের ইস্যু। বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তিত নই।’
গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টাকে লেখা চিঠিতে আদানির চেয়ারম্যান উল্লেখ করেন, আদানি পাওয়ারের গোড্ডা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহে পিডিবির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। আমরা এ পর্যন্ত প্রাপ্ত অর্থ পরিশোধের বিষয়টি স্বীকার ও প্রশংসা করি। বিশেষ করে চলতি বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিশোধিত অর্থ, যা আমাদের বকেয়া স্থিতি আংশিকভাবে কমাতে সাহায্য করেছে। একইভাবে জ্বালানি ও খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহের সঙ্গে সম্পর্কিত আমাদের অন্য সংস্থানগুলো পরিচালনায় কষ্ট লাঘব করতেও সাহায্য করেছে। তবে এখনো প্রায় ৪৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বকেয়া রয়েছে। এই বকেয়া পরিশোধে বিলম্ব আমাদের ঋণদাতা এবং অংশীদারদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি বছরের ২৩ জুন পিডিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, লেট পেমেন্ট সারচার্জসহ সব বকেয়া ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিশোধ করা হবে। কিন্তু বর্তমান বকেয়াটি ঋণদাতাদের মধ্যে গুরুতর উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। কারণ কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সূচি বা কোনো চূড়ান্ত পরিকল্পনা এখনো পিডিবি থেকে জানানো হয়নি। পিডিবির কাছ থেকে ৪৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পাওনা দ্রুত নিষ্পত্তির সুবিধার্থে আমি আপনার (প্রধান উপদেষ্টা) মূল্যবান হস্তক্ষেপ আন্তরিকভাবে কামনা করছি। আমরা আমাদের অংশীদারত্বকে আরও জোরদার করতে এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত করতে আগ্রহী।
এদিকে, আদানির সঙ্গে পিডিবির কয়লার দাম নিয়ে বিরোধ এখনো অমীমাংসিত থেকে গেছে। মতবিরোধটি ঝাড়খণ্ড প্লান্টে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট ব্যয় নিয়ে। গত জুনে একটি ভার্চুয়াল বৈঠকে বিপিডিবি কর্মকর্তারা আদানির কয়লার মূল্য নির্ধারণের সূত্রটি ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার প্রস্তাব করেন। আদানি বিদ্যমান পিপিএর (বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি) নির্দিষ্ট শর্তাবলি উল্লেখ করে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। একই বৈঠকে আদানি প্লান্টের নির্ভরতাযোগ্য সক্ষমতা (ডিপেন্ডেবল ক্যাপাসিটি) সংশোধনের অনুরোধ করা হয়।
পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, যদি কোম্পানিটি বিতর্কিত শুল্ক পর্যালোচনায় সম্মত হয়, তাহলে আদানি পাওয়ারকে শীতকালে ভারতীয় বাজারে বিদ্যুৎ বিক্রির প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হবে। পাশাপাশি সক্ষমতা সংশোধনের জন্য একটি সম্পূরক চুক্তির প্রয়োজন হবে। তারিখ নির্ধারিত না হলেও উভয় পক্ষই অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য শিগগির একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করতে সম্মত হয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই সরকারের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ভারতীয় কোম্পানি আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চুক্তি বাতিলের দাবি উঠে। ব্যাপক সমালোচনার পর সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি আদানির চুক্তি এবং পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খোলা টেন্ডার ছাড়াই স্বাক্ষরিত আরও সাতটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করেছে। পরে পর্যালোচনা কমিটি আদানির চুক্তি আন্তর্জাতিক চুক্তি হওয়ার কারণে পিডিবিকে সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক সালিশ কেন্দ্রের (এসআইএসি) মাধ্যমে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে।
২০১৭ সালে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডা জেলায় ১ হাজার ৪৯৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করে তৎকালীন সরকার। একই বছর আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করে পিডিবি। চুক্তি অনুযায়ী, এই কেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কেনা হবে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও আমদানির তথ্যানুযায়ী, গতকাল বিকেল ৬টায় ১২৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে।