বাণিজ্য খাতে নতুন দিগন্ত ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট
- ১১ অক্টোবর ২০২৫, ২০:১৯
বর্তমান যুগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প এলাকা, কর্পোরেট অফিস, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শপিং মলগুলোতে যে জটিল অবকাঠামো ও প্রযুক্তিনির্ভর কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তা কার্যকরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কাজটিই করে ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট বা সুবিধা ব্যবস্থাপনা খাত। সহজভাবে বলতে গেলে, একটি ভবন বা প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ, কারিগরি সহায়তা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, এমনকি কর্মীদের জন্য সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাই ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্টের মূল দায়িত্ব।
ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট (Facilities Management বা FM) হলো এমন একটি সমন্বিত পরিষেবা খাত যেখানে অফিস, শিল্প কারখানা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসন ও বাণিজ্যিক স্থাপনার দৈনন্দিন কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি সাপোর্ট এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা করা হয়। মূলত একটি প্রতিষ্ঠান যাতে মূল কাজে মনোযোগ দিতে পারে তার জন্য অ-প্রধান কার্যক্রমগুলিকে দক্ষভাবে পরিচালনা করাই FM-এর উদ্দেশ্য। উন্নত বিশ্বে এটি একটি স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে এর বাজার তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশে FM খাত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। তবে দ্রুত নগরায়ণ, রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন, গার্মেন্টস ও শিল্প খাতের সম্প্রসারণ এবং কর্পোরেট সংস্কৃতির প্রসারে এ সেবার গুরুত্ব বেড়েছে। বড় অফিস, ব্যাংক, শপিং মল, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক কমপ্লেক্সে FM-এর ব্যবহার বাড়ছে। বর্তমানে বাজার মূলত আউটসোর্সিং মডেল নির্ভর এবং সীমিত পরিসরে কাজ করছে।
এই খাতটি মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত –
প্রকৌশলিক রক্ষণাবেক্ষণ : ভবনের অবকাঠামো যেমন বিদ্যুৎ, এসি, প্লাম্বিং, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ইত্যাদি।
সেবামূলক রক্ষণাবেক্ষণ : পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা, রিসেপশন, ক্যাফেটেরিয়া, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি।
একটি বড় অফিস ভবন বা হাসপাতাল দিনে দিনে যে পরিমাণ সেবা ও রক্ষণাবেক্ষণ চায়, তা আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই অনেক প্রতিষ্ঠান এখন ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস কোম্পানির ওপর নির্ভর করছে, যারা সবকিছু একত্রে পরিচালনা করে।
বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ, কর্পোরেট সংস্কৃতির বিকাশ, উচ্চ ভবনের সংখ্যা বৃদ্ধি, এবং শিল্প এলাকায় বহুমাত্রিক কারখানার প্রতিষ্ঠা – সবকিছুই ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট শিল্পের চাহিদা বাড়াচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভার এলাকায় অসংখ্য শিল্প কারখানা, অফিস কমপ্লেক্স ও হাসপাতাল রয়েছে, যেগুলোর দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য পেশাদার ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট অপরিহার্য হয়ে উঠছে।
উন্নত দেশগুলোতে এই খাতটি একটি প্রতিষ্ঠিত পেশা হিসেবে স্বীকৃত। যুক্তরাজ্যে এটি বার্ষিক কয়েক বিলিয়ন পাউন্ডের বাজার, আর ভারতে এর বাজার মূল্য প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশেও একই গতিতে এই খাতের বিকাশ ঘটছে, যদিও এখনও এটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
বাংলাদেশে ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট পেশাজীবীদের জন্য সুযোগ তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন সেক্টরে। যেমন-
কর্পোরেট অফিস: বহুতল অফিস, ব্যাংক, বীমা, আইটি কোম্পানি ইত্যাদি।
শিল্প কারখানা: উৎপাদন ইউনিট, গার্মেন্টস, ফার্মাসিউটিক্যালস।
হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান: ক্লিনিক, নার্সিং হোম, মেডিকেল কলেজ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ।
রিয়েল এস্টেট ও হাউজিং প্রজেক্ট: ফ্ল্যাট, কনডোমিনিয়াম, রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স।
শপিং মল ও বাণিজ্য কেন্দ্র: পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা, গ্রাহকসেবা ইত্যাদি।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও হসপিটালিটি সেক্টর: হোটেল, রিসোর্ট, কনভেনশন সেন্টার।
বাংলাদেশে এই খাত এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে সংগঠিত না হলেও অনুমান করা হয় যে আগামী ৫ বছরে এটি ৩,০০০ - ৫,০০০ কোটি টাকার বাজারে পরিণত হতে পারে। এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, সেবা খাতে GDP অবদান বাড়াবে এবং রিয়েল এস্টেট, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও শিল্প খাতকে সহায়তা করবে। তবে দক্ষ জনবল, মান নিয়ন্ত্রণ, প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রসার এবং নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন।
বড় বড় কর্পোরেট ভবন, হাসপাতাল ও শিল্প এলাকায় FM সার্ভিসের জন্য মাসিক লাখ লাখ টাকার চুক্তি হয়। যেমন, একটি ২০ তলা অফিস ভবনের ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট ব্যয় মাসে গড়ে ৫ - ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। বড় শিল্প এলাকায় এই পরিমাণ আরও বেশি। ফলে প্রতি বছরই এই খাতের ব্যবসায়িক টার্নওভার বাড়ছে।
এছাড়া, পেশাদার ম্যানেজার, ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান, নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ বহু লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে এই খাতে। ফলে এটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি বড় অবদান রাখতে পারে।
বাংলাদেশে এখনো অনেকেই ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়। তবে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যেই এর গুরুত্ব অনুধাবন করছে। বিশেষ করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, ব্যাংক, হাসপাতাল ও রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো এই পরিষেবার দিকে ঝুঁকছে।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও এ বিষয়ে আগ্রহ বাড়ছে, কারণ এতে রয়েছে বৈচিত্র্যময় কাজ, নেতৃত্বের সুযোগ, এবং দ্রুত ক্যারিয়ার উন্নয়নের সম্ভাবনা। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন FM সম্পর্কিত কোর্স চালু করার চিন্তাভাবনাও করছে।
যদিও সম্ভাবনা অনেক, তবুও কিছু বাধা এই খাতের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে —
জনসচেতনতার অভাব: সাধারণ মানুষ এখনো বুঝে না, ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট ঠিক কী এবং কেন দরকার।
পেশাদার প্রশিক্ষণের ঘাটতি: বাংলাদেশে এই বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ বা ডিগ্রির ব্যবস্থা এখনো খুবই সীমিত।
নিয়ন্ত্রক নীতির অভাব: সরকারিভাবে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় অনেক সময় সার্ভিসের মান ঠিক রাখা কঠিন।
প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: অটোমেশন বা স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে দক্ষ লোকের ঘাটতি রয়েছে।
বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব: এখনো কিছু প্রতিষ্ঠানই এই সেবা দিচ্ছে, ফলে বাজারে মান নিয়ন্ত্রণ বা তুলনামূলক বিকল্প কম।
বাংলাদেশের শহর ও শিল্পাঞ্চল দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে স্মার্ট সিটি প্রকল্প, মেট্রোরেল, নতুন শিল্পাঞ্চল, বাণিজ্যিক ভবন ও রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের সংখ্যা আরও বাড়বে। এসব জায়গায় ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট অপরিহার্য হয়ে উঠবে।
তাছাড়া, সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ উন্নয়ন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে, যেখানে স্মার্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার রক্ষণাবেক্ষণ একটি বড় বিষয়। ফলে আগামী ১০ বছরে এই খাত বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় সেক্টরে পরিণত হতে পারে।
যদি সরকার ও বেসরকারি খাত যৌথভাবে প্রশিক্ষণ, নীতিমালা, প্রযুক্তি এবং সার্ভিস কোয়ালিটি উন্নয়নে কাজ করে, তাহলে ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির এক নতুন স্তম্ভ।
ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট এখন আর শুধু ভবনের রক্ষণাবেক্ষণের বিষয় নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ পেশা ও শিল্পক্ষেত্র, যা দক্ষতা, প্রযুক্তি ও পরিকল্পনার সমন্বয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে মসৃণ করে। বাংলাদেশের মতো দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির জন্য এটি হতে পারে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ এবং টেকসই উন্নয়নের নতুন দ্বার।
লেখক: প্রকৌশলী মোঃ শফিকুল ইসলাম