ঐতিহাসিক ২৮ অক্টোবর

'লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় রাজপথে নেমেছিলাম'

জালাল
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ ও লেখক।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পেশীশক্তি সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়েছে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর । সেদিন রাজধানী ঢাকা সহ সারাদেশে লগি বৈঠা দিয়ে রাজপথে মানুষ হত্যা করে লাশের উপর দাঁড়িয়ে নৃত্য করার দৃশ্য সবাই দেখে হতবাক। 

সেদিন বিএনপির নেতাকর্মীরা বাংলাদেশের যে কয়েকটি জেলায় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল, তার মধ্যে  কক্সবাজার জেলা অন্যতম।কক্সবাজারের রাজপথে একজন প্রতিরোধ যোদ্ধা হিসেবে আমি ছিলাম।

২৮ অক্টোবর কক্সবাজার জেলার রাজপথে আমরা জেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি এবং যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ এমপি এর নেতৃত্বে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম।

আমাদের এলাকায় বিএনপির বর্তমান 
স্থায়ী কমিটির সদস্য  এই  সালাহউদ্দিন আহমেদ "এপিএস সালাহউদ্দিন" নামে পরিচিত।কারণ তিনি ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সরকারী এপিএস ছিলেন।

সরকারী চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর নির্বাচনে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। সেই বছরের জুন মাসে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী একই নামের সালাহউদ্দিন আহমেদ সিআইপি কে পরাজিত করে বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হন। পাশাপাশি কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।২০০১ সালে জোটগতভাবে নির্বাচন করায় সহজেই বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদ সিআইপি এর সাথে ভোটের ব্যবধান ছিল ৬০ হাজারের বেশি।

২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার আমলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় এলাকায় খুশির বন্যা বয়ে যায়।জোট সরকারের আমলে চকরিয়া উপজেলা থেকে পৃথক করে পেকুয়া উপজেলা প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুল,কলেজ, মাদ্রাসা , থানা প্রতিষ্ঠা করে সালাহউদ্দিন আহমেদ রাজনীতিতে এক বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।

সেদিন বিকেলে কক্সবাজার-১ (চকরিয়া -পেকুয়া উপজেলা)  আসনের এমপি ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ পেকুয়া সদরের শিকদার পাড়ার নিজ  বাড়ী থেকে গাড়ী বহর নিয়ে চকরিয়া থানার রাস্তা মাথায় বিশাল জনসভায় যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে  শেষ ভাষণ দিতে যাওয়ার কথা।

তখন পেকুয়া  থেকে চকরিয়া থানার রাস্তার মাথা এলাকায় যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগের নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ সিআইপি এর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হতো।

সেদিন সকাল থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পেকুয়া - চকরিয়া উপজেলার সীমান্ত ব্রীজ থেকে পহর চাঁদা মাদ্রাসা হয়ে আওয়ামী লীগের নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ (সিআইপি সালাহউদ্দিন নামে পরিচিত) বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার উভয় পাশের গাছ কেটে সড়কে ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করেছে যাতে বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ চকরিয়ার জনসভায় যেতে না পারে। রাস্তা অবরোধের পাশাপাশি কিছুক্ষণ পর পরই ভয় ভীতি সৃষ্টি করার জন্য ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। নেতৃত্ব দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ সিআইপি এর ভাই কমর উদ্দিন আহমেদ। গোলাগুলির শব্দে আমার মা আমাকে বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছে না। চকরিয়ার জনসভায় সালাহউদ্দিন আহমেদ এর বক্তব্য শোনার জন্য যাবো বলেই প্যান্ট, শার্ট সহ প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড় ধৌত করে রেখেছি।মা কোন অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হতে দিবেন না। আমার প্যান্ট, শার্ট লুকিয়ে রেখেছেন। তাই শার্ট এবং লুঙ্গি পরে  ঐদিন দুপুরে জোহরের নামাজের আজান শোনার পর মসজিদে নামাজ আদায় করার নাম দিয়ে ঘর থেকে বের হলাম। নামাজ আদায় করার পর চারদিকের খবরাখবর নিলাম। 

সালাহউদ্দিন আহমেদ কে গতিরোধ করতে পহরচাঁদা এলাকায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছে শুনে সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন করলাম। আমি তখন শিল খালী ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক।

সালাহউদ্দিন আহমেদ এমন একজন নেতা যিনি সকল ধরনের কল রিসিভ করেন। তবে অপরিচিত হলে কোনা কথার রিপ্লাই দিতেন না। তাঁর গ্রামীণ সিমের (01711-565533)  নাম্বারে কল দিয়ে  উনাকে পহরচাঁদা এলাকার সর্বশেষ আপডেট দিলাম।

কিছুক্ষণ পর পরই হাজার হাজার নেতাকর্মী সালাহউদ্দিন আহমেদ স্যার নিয়ে রওয়ানা দিলেন। আমরা প্রথম দফায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া দিলে কেউ খালে, কেউ বিলে এবং কেউ ঘরে ঢুকে যায়। রাস্তার ব্যারিকেড তুলে নেওয়ার জন্য 'বড় দা'( পার্বত্য চট্টগ্রামের গর্জন গাছ কর্তন করার জন্য ব্যবহৃত হয়)   দিয়ে গাছের ডাল পাতা কেটে গাছ গুলো রাস্তার একপাশে সরিয়ে ফেললাম। এভাবে ব্যারিকেড সরিয়ে পহরচাঁদা এলাকার সালাহউদ্দিন আহমেদ সিআইপি এর বাড়ির পাশে যেতেই মুহুর্মুহু গুলি। 

তখন বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ  অবস্থান করছেন  আওয়ামী লীগের কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ সিআইপি এর বাড়ির ১০০/১৫০ হাত পেছনে(ফজরের মৌলভী বাড়ি)। আওয়ামী লীগ নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ এর বাড়ি থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিলেন তাঁর ভাই কমর উদ্দিন আহমেদ সহ তিন। আমি ,পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি রেজাউল করিম রেজা ভাই সহ আমরা তিনজন দৌড়ে পেছনে পালিয়ে না এসে আসতে  দাঁড়িয়ে পেছনে আসতে শুরু করি। আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারীকে আমাদের নাগালের মধ্যে আনতেই তাদের কে পাল্টা ধাওয়া দিলে একজন খালে ঝাঁপ দেয়, একজন পাশ্ববর্তী একটা বাড়ির পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দলনেতা কমর উদ্দিন আহমেদ ধানক্ষেতে লাফ দেন।

 বিএনপির নেতাকর্মীরা ইচ্ছেমতো তাদের কে উত্তম মধ্যম দেওয়ার পর রাজপথ দখলে  নিয়ে‌ নেন। বিএনপির নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের সালাহউদ্দিন আহমেদ এর বাড়ির সামনের রাস্তা অতিক্রম করার সময় আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে আগে থেকেই জমানো ইট ,পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে সন্ত্রাসীরা । একটা শক্ত ইটের টুকরা আমার হাঁটুতে আঘাত করে।

আমরা পহরচাঁদা কুতুব বাজার হয়ে চকরিয়ার জনসভায় যেতে থাকি। মাঝপথে বরইতলীর  তৎকালীন চেয়ারম্যান এটিএম জিয়াউদ্দিন জিয়ার বাড়ির সামনে আরো একটি বেরিকেডের সম্মুখীন হলাম। সেই বাঁধা  ডিঙিয়ে আমরা আসরের নামাজের পর চকরিয়ার থানার রাস্তার মাথায় জনসভায় স্থলে পৌঁছালাম। সেদিন বাড়িতে এসে আমার পরিবারের বড় ভাই এবং মা আমার রক্তাক্ত শরীর দেখে বকা দিলেন।
সেই দিন রাতে টিভিতে ঢাকা শহরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নৃশংস হত্যাকান্ডের ভিডিও ফুটেজ দেখে অবাক হয়েছিলাম।

রাজপথ দখলে রাখার ফসল উঠেছিল বিএনপির ঘরে :
২০০৮ সালের নির্বাচনে সারাদেশে বিএনপি'র চরম ভরাডুবির মধ্যেও কক্সবাজার  জেলার ৪টি আসনের মধ্যে ৩টি আসনে বিএনপি -জামায়াতের প্রার্থীরা  বিজয় লাভ করেন।১/১১ এর সময় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সালাহউদ্দিন আহমেদ কে সাজা দিলে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ ১ লাখ ৫৬ হাজারের অধিক ভোট পেয়ে  নির্বাচিত হন। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি  আওয়ামী লীগের প্রার্থী সালাউদ্দিন আহমেদ সিআইপির সাথে ভোটের ব্যবধান ছিল ৩৬ হাজার। দক্ষিণ চট্টগ্রামে তিনি ই প্রথম নির্বাচিত মহিলা এমপি ছিলেন। আশেপাশের  নির্বাচনী এলাকাতেও বিএনপি এবং জামায়াতের প্রার্থীরা জয় লাভ করেন। সেবার জামায়াত সারাদেশে মাত্র দুটি আসন জিতেছিল। দুইটাই আমার এলাকার  পাশে। একটি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া লোহাগাড়া এবং অপরটি কক্সবাজার-২ (মহেশখালী ও কুতুবদিয়া)।

লেখক: সাবেক ডাকসু ভিপি প্রার্থী