কোন পথে নির্বাচন কমিশন?
- ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৫৪
বাংলাদেশে জাতীয় ভোটের সময় নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম দেখলে পবিত্র কোরআনের সুরা কাহাফের ১০৩ ও ১০৪ নম্বর আয়াতটি মনে পড়ে। রকিব-হুদা-আউয়াল কমিশনগুলোর কাণ্ড-কারখানা ও তাদের জেল বন্দিত্ব এবং বর্তমান নাসির কমিশনের আমলা গুলো মনশ্চক্ষে তোলপাড় তোলে।
ওই দু’টি আয়াত পাঠে সবাই নিজের দিকে তাকায়। মহান আল্লাহ কি আমার উদ্দেশ্যেই এটা বলেছেন? শিরদাঁড়া কেঁপে যায়। আলোচ্য আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ বলছেন, “ (হে নবী)” তুমি বলো আমি কি তোমাদের এমন লোকদের কথা বলবো, যারা আমলের দিক থেকে আসলেই ক্ষতিগ্রস্ত; (এরা হচ্ছে) যে সব লোক যাদের সমুদয় প্রচেষ্টাই এ দুনিয়ায় বিনষ্ট হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে মনে ভাবছে তারা (বুঝি) ভালো কাজই করে যাচ্ছে। তাফসীর হল, এ দুই আয়াত এমন ব্যক্তি ও দলকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যারা কোন কোন বিষয়কে সৎ মনে করে তাতে পরিশ্রম করে। কিন্তু আল্লাহ’র কাছে তাদের সে পরিশ্রম বৃথা এবং সে কাণ্ড নিস্ফল। ইসলামি পণ্ডিত কুরতবী বলেন : এ অবস্থা দুটি কারণে সৃষ্টি হয়- ১. ভ্রান্ত বিশ্বাস ২. লোক দেখানো মনোবৃত্তি। তাদের আমল বাহ্যত বিরাট বলে দেখা যাবে, কিন্তু হিসাবের দাঁড়িপাল্লায় তার কোন ওজন হবে না। ইসলামী চিন্তাবিদদের মত হল, আমল আল্লাহ’র উদ্দেশ্যে হলেও যদি তার সাথে কোনরূপ সুখ্যাতি ও প্রসার প্রতিপত্তির বাসনা থাকে, তবে তাও এক রকম গোপন শির্ক। কেয়ামতের দিন আল্লাহ শির্ক বা রিয়াকারীদের বলবেন, তোমরা তোমাদের কাজের প্রতিদান নেয়ার জন্য তাদের কাছে যাও, যাদেরকে দেখানোর উদ্দেশ্যে তোমরা কাজ করেছিল। হযরত উমর (রা:) নবীজীকে বলতে শুনেছেন, যে ব্যক্তি সুখ্যাতি লাভের জন্য সৎকর্ম করে আল্লাহতায়ালাও তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেন যে, যার ফলে সে ঘৃণিত ও লজ্জিত হয়ে যায়।
২০১৪, ২০১৮ এবং চব্বিশের নির্বাচন কমিশনার ও ভোট পরিচালনাকারীদের আল্লাহ সম্ভবত খুনী হাসিনার কাছে প্রতিদান নেয়ার কথা বলতে পারেন। কেননা ওই স্বৈরাচারকে খুশি করতেই তারা নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের কী হবে? তাদেরকে কি ড. ইউনূস অথবা বিএনপি-জামায়াতের নেতৃবৃন্দের কাছে পাঠাবেন, যাদেরকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য তারা ভোট করছেন? ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টার দাবি, সেটি এমন ভোট উৎসব হবে, দুনিয়ায় তাক লেগে যাবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারেরও সুরে বক্তব্য আছে। সুখ্যাতির জন্য বা লোক দেখানোর কর্মকাণ্ড আল্লাহ পছন্দ করেন না।
বিএনপি জামায়াতের পছন্দের তালিকা থেকে আসা নাসির কমিশনের অধিকাংশ সদস্য এবং কমিশনের সচিব আমলাতান্ত্রিকতায় দুরস্ত। আইন বা বিধির বাইরে যান না বা তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন, এমন শরীরী ভাষায় বাকবাকুম। কিন্তু তাদের কাজ কর্মে কি তেমনি প্রতিফলন আছে?
চব্বিশের দুনিয়া কাঁপানো গণঅভ্যুত্থানের পর তারা এসেছেন। কিন্তু ওই বিপ্লবের চেতনা কি তারা ধারণ করেন? বদিউল আলম মজুমদার, যিনি নির্বাচন ব্যবস্থার গলদ দূর করতে হরহামেশাই পেরেশোন, তাঁর নেতৃত্বাধীন নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই অবস্থান নিয়েছে নাসির কমিশন। নির্বাচন কমিশনকে কোন কর্মের জন্য সংসদীয় কমিটির জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যেতে হবে- এমন সুপারিশের বিপক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভূমিকা ছিল অনেকটাই যৌক্তিক। তবে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের জেলে যাওয়ার বিপরীতে সংসদের একটা বিচারে কমিশন সদস্যদের দায়মুক্তির চিন্তা থেকে মজুমদার কমিশন এমন প্রস্তাব করেছিলেন কিনা জানি না। তবে এটা সত্য, মজুমদার কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশ নাসির কমিশন বা ইউনূস সরকার পাত্তাই দেয়নি। নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বিধিমালা সহজ করতে মজুমদার কমিশন সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তার ধারে কাছে যায়নি বর্তমান নির্বাচন কমিশন। বরং এক এগারোর ছদ্মবেশী সামরিক সরকার প্রণীত বিধিমালাকেই আঁকড়ে ধরেছে। ২৪-এর বিপ্লবী চেতনায় গঠিত দলগুলোর নিবন্ধন নিয়ে নাটক করছে। এনসিপির সঙ্গে প্রকাশ্য যুদ্ধে নেমেছে, যদিও প্রতীক শাপলা না দিয়ে সরকারের চাপে শাপলা কুঁড়ি পর্যন্ত এসেছে। আম-জনতা পার্টির মহাসচিব তারেকের অনশন এই কমিশনের বড় ব্যর্থতা।
অতীতের কমিশনগুলো যখন নতুন দলকে নিবন্ধন দিয়েছে, তারা নীরবেই এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। কিন্তু নাসির কমিশন এবার দরখাস্ত করা ১৪৭টি দলের মধ্যে প্রাথমিক বাছাইয়ে ২২টি দলকে উত্তীর্ণ করেছে। দ্বিতীয় বাছাইয়ে ১০টি দলকে মনোনীত করেছে। পরে আবার বলেছে যে, মাঠ পর্যায়ে কমিশনের তদন্তে অসম্পূর্ণতা আছে বিধায় অধিকতর তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। প্রথমে এনসিপি ও জাতীয় লীগকে নিবন্ধন দিয়ে পরে জাতীয় লীগকে বাদ দিয়ে ওই ১০টির দু’টো দলকে ভোটের লাইসেন্স দিয়েছে।নেজামে ইসলাম নামে জামায়াত ঘনিষ্ঠ এক দল ২২টির মধ্যে থাকা অবস্থায় উচ্চ আদালতে গিয়ে নিবন্ধন নিয়ে এসেছে। কমিশন সেখানে তাদের আইনজীবীই পাঠায়নি। এসব নাটকের কি দরকার ছিল? ভোট পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে।
নাসির কমিশনের সবচেয়ে বড় অর্মাজনীয় ত্রুটি হল, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ছাড়াই অর্থাৎ আলোচনা না করেই নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছে। ইউনূস সরকার তা অনুমোদনও করে দিয়েছে। সংশোধিত আইনে নির্বাচনী জোটে অন্তর্ভুক্ত দলগুলোকে নিবন্ধিত হতে হবে এবং নিজস্ব প্রতীকে ভোট করতে হবে। জোটের বড় দলের প্রতীকে ভোট করতে পারবে না। এর অর্থাৎ অতীতের সব নির্বাচনে যেমন করে অনিবন্ধিত দল জোটের গিয়ে ভোট করতে পারত এবার তা হবে না। করতে চাইলে বড় দলে যোগ দিতে হবে। এটা তো বহুদলীয় গণতন্ত্রের বদলে একদলীয় ব্যবস্থাকে সমর্থন করা? অভিযোগ, নির্বাচনকে অবাধ করার বদলে টাইট করে দেওয়া হল। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দরজা কুখ্যাত হাসিনা জটিল করে দিয়েছিল। মোট ভোটারের ১ শতাংশের লিখিত সমর্থন নিয়ে মনোনয়নপত্র পেশ করতে হবে। খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু নাসির কমিশন বড় দলগুলোর কথায় হয়তো সেই বিধান এখনও রেখে দিয়েছে। অথচ বিএনপি-জামায়াত ভোটের পরে জাতীয় সরকার গঠন এবং ফ্লোরক্রসিং সম্পর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধনের ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে। তা না হলে ছোট দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য এই বিধান রাখা হচ্ছে কেন?
নাসির কমিশনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ আছে। এনসিপি বলেছে এই কমিশন বিএনপি ও জামায়াত ভাগাভাগি করে নিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী যখন পিআরের দাবিতে সোচ্চার তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বললেন, সংবিধানে পিআর নেই। আমাদের প্রস্তুতি সংবিধান বর্ণিত নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে। ভাল কথা-এটা সাংবিধানিক অবস্থান। গণভোট অনুষ্ঠানের সময়সীমা নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের কাইজ্যা যখন তুঙ্গে তখন একজন নির্বাচন কমিশনার বলে বসলেন, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট করা গেলে খরচ কমবে। কিন্তু গণভোট তো সংবিধানে তখনও পুন:প্রতিস্থাপিত হয়নি বা এখন নেই, তা হলে এটা বললেন কি করে? সাংবিধানিক অবস্থান নিয়ে দু’রকম মন্তব্য। নির্বাচন কমিশন একটি কোয়াসি জুডিসিয়াল বডি। যখন তখন মন্তব্য করা সাজে না।
ড. ইউনূস বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুগ্ধ দৃষ্টি অর্জন বা ভারতের সাবেক স্বনামধন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার টিএন সেশনের মতো খ্যাতিসম্পন্ন হওয়ার মনোবাঞ্ছা নিয়ে বাংলাদেশের আসন্ন কঠিন নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে গেলে বিপদ হবে। বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য, বৈষম্যমুক্ত অবাধ ভোট করতে গেলে নিরপেক্ষ এবং মুক্তমনা ভোট পরিচালক দরকার। নির্বাচনের আগে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবস্থা, দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত ও বঞ্চিতদের রক্তারক্তি, ভোটের প্রচারণার নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করা আর মনোনয়ন বাণিজ্য সর্বোপরি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের প্রশাসনিক মাতব্বরি-এসব নিয়ে কমিশন নীরব কেন? নাসির কমিশন কিu অন্তর্বর্তী সরকারের প্রত্যঙ্গ সংস্থা? বিনীত অনুরোধ আপনারা নিজের দিকে তাকান, আল্লাহ’র নির্দেশাবলী অনুসরণ করে তাঁর সন্তুষ্টি আদায় করুন।
লেখক: সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ও বিএফইউজে।