যেভাবে ফ্যাসিবাদের পক্ষে কাজ করছে এপিডি উইংয়ের ৩ কুতুব

জনপ্রশাসন

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদ ‘নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অনিয়ম, দূর্নীতি যেন ওপেন সিক্রেট। বিশেষ করে শেখ হাসিনার পতনের পর ফ্যাসিবাদের পক্ষের আওয়ামীমনা কর্মকর্তাদের কৌশলে বদলি ও পদায়নের মাধ্যমে পুরো প্রশাসনকে কব্জায় নিয়েছে এই সিন্ডিকেট। আর এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা যুগ্ম-সচিব মিঞা মোহাম্মদ আশরাফ রেজা ফরিদী, উপসচিব তৌহিদ বিন হাসান ও মোহাম্মদ বারিউল করিম খান। 

মিঞা মোহাম্মদ আশরাফ রেজা ফরিদী: জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ বা এপিডি উইংয়ের সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন ঊর্ধ্বতন নিয়োগ অধিশাখার যুগ্মসচিব মিঞা মোহাম্মদ আশরাফ রেজা ফরিদী। প্রশ্ন উঠেছে কে এই ফরিদী? তার ক্ষমতার উৎস কোথায়? 

জানা গেছে, শেখ হাসিনার পতনের পর নিজেকে বিএনপি বলে পরিচয় দেন অথচ পদোন্নতি পেয়েছেন নিয়মিত এবং ফ‍্যাসিস্টের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের মত গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরেই কাজ করেছেন। তার কাজ উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব বদলি-পদায়ন-পদোন্নতি কিন্তু তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন ডিসি পদায়ন থেকে শুরু করে সংস্থা প্রধান নির্বাচন। সম্প্রতি কক্সবাজারের ডিসি বা চট্টগ্রামের ডিসি পদায়নকে কেন্দ্র করে উপদেষ্টা কমিটির সাথে যে মতবিরোধের কথা শোনা যায় তার মূলেও আছেন এই ফরিদী। তার পছন্দের লোককে ডিসি বানাতেই সরে যেতে হলো জনপ্রশাসন সচিবকে। তার শ‍্যালক ও ব‍্যাচমেট হচ্ছেন আবু নঈম মোহাম্মদ মারুফ খান যিনি ছিলেন নরসিংদীর ডিসি ও ফ‍্যাসিস্টের সচিব এম সাজ্জাদুল হাসান এবং মুখ‍্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার একান্ত সচিব (বর্তমানে পরিবেশ উপদেষ্টার একান্ত সচিব হিসাবে বহাল তবিয়তে আছেন)। প্রশাসনে তিনি বৈষম‍্যবিরোধী কর্মচারী ঐক‍্য পরিষদের আহ্বায়ক সাবেক সচিব এবিএম সাত্তারের লোক বলে পরিচিত এবং এটাই তার শক্তির উৎস। সম্প্রতি “৮ উপদেষ্টার সীমাহীন দুর্নীতির প্রমাণ হাতে আছে” মর্মে মন্তব্য করে ব‍্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। তার পরিচয় এমন অনেকেই ব‍্যবহার করছেন এবং তার নামেই বিভিন্ন বদলি-পদায়নের তদবির আসে বটে তবে আর্থিক লেনদেনের প্রসঙ্গ আসলে নাম আসে মোঃ আব্দুল খালেকের নাম। মূলতঃ সাত্তারকে সামনে রেখে বদলি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন আব্দুল খালেক।বৈষম‍্যবিরোধী আন্দোলনের নামে জনপ্রশাসন অচল করে দিয়েছিলেন এই আব্দুল খালেকরা। তিনি এতটাই আগ্রহী ছিলেন এসব কাজে সাত্তারের স্বাক্ষর নকল করে বা তার অনুমতি ব‍্যতিরেকে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। তারা ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পাওয়া ১১৯ সচিবের মধ‍্যে অন‍্যতম যাদের দাবি ছিলো চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া জনপ্রশাসন সচিব, ক‍্যাবিনেট সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিবসহ অন‍্যান‍্য সচিবদের চুক্তি বাতিল করে তাদেরকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা। মূলতঃ এটি লক্ষ‍্য থাকলেও ৫ আগস্ট-পরবর্তী অস্থির পরিবেশে কখনো এডমিন ক‍্যাডারের জুনিয়র কর্মকর্তাদের ৫০-৫০ ইস‍্যুতে আন্দোলন, অন‍্যান‍্য ক‍্যাডারের চাকরির মোট বয়সকাল হিসাব করে পদোন্নতি, সরকারি চাকরি অধ‍্যাদেশ নিয়ে কর্মচারীদের আন্দোলন, ইত‍্যাদি সকল আন্দোলনকে সামনে এনে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ঐসব আন্দোলনকে করেছেন বিতর্কিত এবং সরকারকে করতে চেয়েছেন অস্থিতিশীল।

জানা গেছে, ঢাকা ডিসি অফিসের এডিসি (এল.এ) হিসেবে কর্মরত ছিলেন খালেক। সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি বিভিন্ন খাসজমি ব‍্যক্তি নামে লিখে দিয়েছেন “পুকুর চোর” খ‍্যাত এই কর্মকর্তা। শুধু তাই নয় ছিলেন ২মাসের চাঁদপুরের এবং ২দিনের জন‍্য যশোরের জেলা প্রশাসক। বর্তমানে অফিসার্স ক্লাবের অনির্বাচিত ট্রেজারারের দায়িত্ব পালন করছেন এবং ক্লাবটিকে সিন্ডিকেটের আস্তানা বানিয়েছেন। সম্প্রতি পল্লী সঞ্চয় ব‍্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবেও নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী সচিব হিসেবেও শোনা যাচ্ছে তার নাম। এদিকে ৫ আগষ্টের পর ভোল পাল্টে মিঞা আশরাফ রেজা ফরিদী এখন নিজেকে বুয়েট ছাত্রদলের সাবেক নেতাার পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছেন। শুধু তাই নয় সে নিজেকে তারেক জিয়ার সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ হয় বলেও চাউর করান। তার সাথে তারেক জিয়ার যোগাযোগের সূত্র হিসেবে ধরা হয় বগুড়ার একজন ব‍্যক্তি। 

শুধু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নয়, ৫ আগস্ট পরবর্তী দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশের সুযোগে এই সিন্ডিকেট তার প্রভাব বিস্তার করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এই সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় ৫ আগস্টের পর ডিজারশন ও অসদাচরণের অভিযোগে চাকরি হতে বরখাস্তকৃত ফ‍্যাসিস্ট সহযোগী স্বরাষ্ট্রের সাবেক যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাসের বিশ্বস্ত বিকাশ বিশ্বাস প্রায় ৪ বছর ধরে স্বরাষ্ট্রে থাকলেও অদ‍্যাবধি সেখানেই আছেন এবং উপসচিব প্রমোশনও পেয়েছেন। এই ফরিদী সিন্ডিকেটের সহায়তায় অর্থ মন্ত্রণালয়েও বহাল তবিয়তে বর্তমান রয়েছেন সাবেক অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদারের সহযোগীরা। ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর থেকে সরিয়ে দেওয়া বহু কর্মকর্তাকে অর্থের বিনিময়ে/স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে পুনরায় আবার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়/বিভাগে পুনর্বহাল করছে এই সিন্ডিকেট। 

মোঃ তৌহিদ বিন হাসান: এপিডি উইংয়ে ফরিদীর ডানহাত আরেক কর্মকর্তা উপসচিব তৌহিদ বিন হাসান, যার খালুশ্বশুর কর্নেল দিলাওয়ার হচ্ছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের খুনের একজন আসামী হিসেবে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত। তিনি নিজে ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা (ARO) হিসেবে নির্বাচনের আগের রাতে দুই-তৃতীয়াংশ ব‍্যালট বাক্স ভরে ফেলেছিলেন। 

তার পিতা মোঃ আহসান আলী দুদকের উপপরিচালক হিসেবে দুর্নীতির অভিযোগে বাধ‍্যতামূলক অবসর পেয়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি উইংয়ের কর্মকর্তা হিসাবে তিনি এসএসবি সভার তথ‍্য নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের কাছে ফাঁস করেন এবং সিন্ডিকেট সেই তথ‍্য ধরে বিভিন্ন পদোন্নতি/পদায়নপ্রত‍্যাশী কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, এপিডি উইংয়ের এসএসবি এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে টাকার বিনিময়ে পদোন্নতি-পদায়নের চুক্তি করে।

সম্প্রতি ৩০তম ব‍্যাচের উপসচিব পদে পদোন্নতি প্রত‍্যাশী একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে বলা হয় তার রিপোর্ট খারাপ, তারপরেও পদোন্নতি করে দিতে পারবে যদি তারা (বিভিন্ন লেয়ারে দিতে হবে+সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকেসহ ১১ লাখ) এরকম কনট্রাক্টে আসেন। 

এপিডি উইংয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সকল ক‍্যাডার পদে পদোন্নতির কাজ করা হয় ঊনি-১ শাখা থেকে অথচ ঊর্নি-৩ শাখায় কর্মরত তৌহিদ বিন হাসান উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতি শুধু নয়, এ সকল পদে পদায়ন, পিএস নিয়োগ, ইউএনও/এডিসি/ডিসি নিয়োগসহ বিভিন্ন শাখার কার্যক্রমে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/দপ্তরে নিজের লোক পদায়নের মাধ্যমে একটি অনুগত গ্রুপ সৃজন করেছেন যারা ঐসব মন্ত্রণালয়/বিভাগের অভ‍্যন্তরীণ প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেন। 

আওয়ামী সুবিধাভোগী এই সুবিধাবাদী কর্মকর্তা তার ব‍্যাচের আওয়ামী সুবিধাভোগী বিভিন্ন কর্মকর্তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। 
তৌহিদ বিন হাসান ৫ আগস্টের আগে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে গাজীপুরের সহকারী কমিশনার, ঢাকার লালবাগ সার্কেলের এসিল‍্যান্ড, নারায়ণগঞ্জের বন্দরের এসিল‍্যান্ড, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। কথিত আছে, এপিডি উইংয়ে বিগত ফ‍্যাসিস্ট সরকারের আমলে বদলি বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের হোতা সাবেক ডিবি প্রধান মনিরুলের স্ত্রী সায়লা ফারজানা এবং তার বশংবদ কে এম আল আমীন, ভাস্কর দেবনাথ, নাজমা নাহারকে খুশি করার মাধ্যমে তিনি ২০২৩ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ পান। ৫ আগস্টের পরে ভোল পাল্টে এই কর্মকর্তা রাতারাতি বিএনপিপন্থী বনে গিয়ে জনপ্রশাসনের বর্তমান সিন্ডিকেটকে মাসোহারা প্রদানের মাধ্যমে এপিডি উইংয়ে অনুপ্রবেশ করেন। 

মোহাম্মদ বারিউল করিম খান: শেখ হাসিনার আমল থেকে জনপ্রশাসনে থাকা আগের সিনিয়র সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী (কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরীর ভাগ্নে) এর পিএস ছিলেন করিম খান। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে বদলি হওয়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ড. মোখলেসুর রহমানও প্রায় ৮ মাস তার সাথে রেখেছিলেন। 

এই সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় বারিউল করিম জনপ্রশাসনেই রয়ে গেছেন। সম্প্রতি ৩০তম ব‍্যাচের পদোন্নতির আগে পিএস থেকে সরিয়ে এপিডি উইংয়েই অভ‍্যন্তরীণ নিয়োগ শাখায় বদলি হয়ে আসেন করিম খান। 

সূত্র জানায়, ৩০ ব‍্যাচের উপসচিব প্রমোশনে যে ২৫/৩০ প্রত‍্যাশী নিরীহ ছেলেমেয়ে বাদ পড়েছে এবং পরিবর্তে সমান সংখ্যক ছাত্রলীগ/ফ‍্যাসিস্টের সহযোগী পদোন্নতি পেয়েছে তার মূল কারিগরও এই বারিউল করিম খান। ফ‍্যাসিস্ট সময়েও সরব থাকা করিম খান ২০২১ সালে ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, “যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলার মানুষকে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সেই সোনার বাংলা গড়ে তুলছি আমরা তিলে তিলে”।