আন্ত:ক্যাডার বৈষম্য বাড়ার শঙ্কা তীব্র হচ্ছে
নিজস্ব প্রতিবেদক : জনপ্রশাসনে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে তাদের তফসিলভুক্ত ৩ হাজার ৯৭টি পদকে দ্বিগুণ করে ৭ হাজার ৭৬টি করেছে। ‘বিসিএস (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) কম্পোজিশন অ্যান্ড ক্যাডার রুল, ১৯৮০’ বিলুপ্ত করে গত ২০ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) গঠন ও ক্যাডার আদেশ, ২০২৪’ জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। নতুন আদেশে প্রশাসন ক্যাডার থেকে উপসচিব হওয়া কর্মকর্তাদেরও ক্যাডার কম্পোজিশনে তফসিলভুক্ত দেখানো হয়েছে।
সরকারি চাকুরেদের ‘কর্মচারী’র বদলে ‘কর্মকর্তা’ এবং ‘ডেপুটি কমিশনার’-এর বদলে ‘জেলা প্রশাসক’ বলা হয়েছে। অথচ সরকারি চাকুরেরা ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ হিসেবে পরিচিত। সংশ্লিষ্ট আইন ও অন্যান্য নিয়োগ বিধিতেও কর্মচারী শব্দ আছে।
নতুন এই আদেশ জারির ফলে আন্তক্যাডার বৈষম্য আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন অন্য একাধিক ক্যাডারের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তা। প্রকৃচির (প্রকৌশল-কৃষিবিদ-চিকিৎসক) নির্বাহী কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘বছরের পর বছর ধরে এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করা হচ্ছে। প্রশাসন ক্যাডার কম্পোজিশন আপডেট করার নামে নিজেদের পদ যেভাবে বাড়ানো হয়েছে, অন্যান্য ক্যাডারের ক্ষেত্রেও তা করার দাবি জানাচ্ছি। এটি না করা হলে আন্তক্যাডার বৈষম্য আরও বাড়বে।’
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞেরাও বলছেন, ‘কর্মচারী’ বদলে ‘কর্মকর্তা’ করাটা সংশ্লিষ্ট আইন ও নিয়োগবিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ছাড়া আদেশটিতে একাধিক অসংগতি আছে বলেও তাঁরা মনে করেন। তাঁদের মতে, এসব অসংগতি নানা জটিলতার সৃষ্টি করবে।
তবে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘এই আদেশের মাধ্যমে ক্যাডার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা জোরদার হবে। এটি সর্বশেষ হালনাগাদ হয়েছিল ১৯৯২ সালে। গত ৩০-৩২ বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যেসব ক্যাডার পদ নতুন হয়েছে, তা প্রশাসন ক্যাডারের প্রাপ্য পদগুলোর কম্পোজিশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া ইকোনমিক ক্যাডারের একীভূত পদগুলো যুক্ত হয়েছে। এতে অন্য ক্যাডারের সঙ্গে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে না। কারণ, অন্য ক্যাডারের কোনো পদ এতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।’
নতুন আদেশে প্রশাসন ক্যাডারের লাইন পদের সঙ্গে আরও কিছু পদ যোগ হয়েছে। বাড়তি পদ যোগ করতে গিয়ে ভিন্ন আইনে সৃষ্ট পদও এই আদেশ দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের তফসিলভুক্ত করা হয়েছে। যেমন, বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি) ভিন্ন একটি আইনি প্রতিষ্ঠান এবং এর রেক্টর পদে নিয়োগের বিষয়টিও সেই আইনে উল্লেখ আছে। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের তালিকাভুক্ত পদ হয়ে যাওয়ায় এখন শুধু প্রশাসন ক্যাডার থেকেই নিয়োগ দিতে হবে। একইভাবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদটিকেও প্রশাসন ক্যাডারের তফসিলভুক্ত করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, এনাম কমিটির সুপারিশ ও জনবলকাঠামোর তুলনায় জনপ্রশাসনের আকার বহুগুণ বেড়েছে। বিলুপ্ত সচিবালয় ও ইকোনমিক ক্যাডার প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত হয়েছে। আরও কয়েকটি ক্যাডারের একীভূত হওয়ার প্রস্তাব আছে। এসব কারণে এই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। বর্তমানে জনপ্রশাসনে ২৬টি ক্যাডার। কোনো কোনো ক্যাডারের উপ-ক্যাডারও আছে।
জানা যায়, প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের বিরোধ দীর্ঘদিনের। প্রশাসন ক্যাডার আদেশ নতুনভাবে জারি করা হলেও অন্যান্য ক্যাডার আদেশ সংশোধন না করায় সংশ্লিষ্ট ক্যাডার কর্মকর্তাদের অসন্তোষ আছে।
কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (কেআইবি) দপ্তর সম্পাদক কৃষিবিদ এম এ মিজানুর রহমান বলেন, ‘যেখানে আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের পদ দ্বিগুণ করে বৈষম্য আরও বাড়ানো হচ্ছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। অবিলম্বে অন্যান্য ক্যাডার কম্পোজিশন আপডেট করার দাবি জানাচ্ছি।’
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মো. ফিরোজ মিয়া এই বিষয়ে বলেন, ‘এই আদেশের ফলে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই আদেশে বেশ কিছু অসংগতি রয়েছে। যেমন বিদ্যমান সব আইন ও নিয়োগবিধিতে সরকারি চাকুরেদের “কর্মচারী” বলা হলেও আদেশে “কর্মকর্তা” বলা হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডার থেকে উপসচিব হওয়া কর্মকর্তাদেরও ক্যাডার কম্পোজিশনে তফসিলভুক্ত দেখানো হয়েছে। অথচ কোনো ক্যাডার থেকে সরকারের পদে (উপসচিব) গেলে তিনি আর আগের ক্যাডারে ফেরত যেতে পারেন না। তাহলে অন্যান্য ক্যাডার থেকে উপসচিব হওয়া কর্মকর্তাদের কী হবে? এই নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হবে।’ সাবেক এই কর্মকর্তার মতে, প্রশাসন ক্যাডারের ন্যায় অন্যান্য ক্যাডারের পদও আপগ্রেডেশন করা উচিত।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডার কম্পোজিশন আপডেট করে পদসংখ্যা বাড়িয়েছে। আমাদেরটাও বাড়ানো জরুরি। কিন্তু বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কম্পোজিশনভুক্ত পদে অন্য ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের পদায়ন হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এই নিয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি প্রতিবাদ করে আসছে। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসনের নির্দেশনা দিয়েছেন। এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন জরুরি।’
খাদ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডারের স্বার্থ মাথায় রেখে নিজেরাই নিজেদের আইন ও বিধি তৈরি করছে। অথচ আমাদের ক্যাডারের সমস্যার অন্ত নেই। ক্যাডার-সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব পাঠানো হলে বছরের পর বছর ফেলে রাখা হয়।’
জনপ্রশাসনসচিব অবশ্য জানিয়েছেন, অন্যান্য ক্যাডারের কম্পোজিশনও হালনাগাদ করা হবে। তিনি বলেন, ‘অনেক নতুন পদ তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ক্যাডারের আওতায়। এগুলো সবই সংশ্লিষ্ট ক্যাডার কম্পোজিশনে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। কিছু কিছু ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় বা বিভাগ এই নিয়ে কাজ করছে।’
Share your comment :