এ দায় কার?
স্টাফ রিপোর্টার
শনিবার ছেলে মুগ্ধকে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করাবেন স্ত্রীকে এমনটি জানিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন কুষ্টিয়া শহরের আলফা মোড়ের বাসিন্দা রেজাউল করিম ওরফে মধু (৩৮)। কয়েক ঘণ্টা পরও বাড়ি না ফেরায় ঘরে অসুস্থ স্ত্রী শেফালি খাতুন চিন্তিত হয়ে পড়েন। পরে তিনি নিজেই খুঁজতে খুঁজতে তাদের ভাড়া বাসায় যান । সেখানে দেখেন তাদের বাসা ভেতর থেকে তালাবদ্ধ। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পান তার ছেলে ও স্বামী পৃথক দুটি দড়িতে ঝুলে আছে। তখন তার চিৎকারে আশপাশের বাসিন্দারা সেখানে এসে জড়ো হয়। খবর পেয়ে পুলিশ এসে দুজনের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে। পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় হত্যা ও আত্মহত্যা দুটি বিষয় থাকতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, ছেলেকে হত্যার পর রেজাউল নিজে আত্মহত্যা করেছেন। স্বজনরা জানিয়েছেন, রেজাউল ৮ বছর আগে ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করেছেন।
ধর্মান্তরিত হওয়ার পর রেজাউল এনআইডি সংশোধন নিয়ে জটিলতায় পড়েছিলেন। এজন্য ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারেননি। এ নিয়েও তার মধ্যে ক্ষোভ ছিল। তাই অকালেই তিনি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। সঙ্গে তার সন্তানকেও ঠেলে দিলেন অকাল মৃত্যুর দিকে।
একইদিন খুলনা ডুমুরিয়ায় দুই সন্তানকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যার পর গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন এক মা। শনিবার দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার কোমলপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, পারিবারিক কলহের জের ধরে আব্দুল মান্নান সরদারের স্ত্রী ডলি বেগম তার চার বছরের মেয়ে ফাতেমা খাতুন ও সাত মাসের ছেলে ওমর আলী সরদারকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেন। এরপর নিজে ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। স্বজনরা জানিয়েছেন, ডলি বেগমের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আর ঘরের মধ্যে খাটের উপর পড়ে ছিল শিশু ফাতেমা খাতুন ও ওমরের লাশ। ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো ছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে হৃদয়স্পর্শী এমন ঘটনা প্রায়ই দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে। বিশেষ করে নিজের সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করার মতো ঘটনাগুলো এখন অনেকটা হরহামেশাই হচ্ছে। হত্যার পর আত্মহত্যা, আত্মঘাতী এসব ঘটনা যেমন সবাইকে নাড়া দিয়ে যায় তেমনি সমাজের কাছে কিছু বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এমন কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যায় যেগুলো নিতান্তই তুচ্ছ কারণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। যদিও যিনি আত্মহত্যা করছেন তার কাছে হয়তো এসব কারণ এতটাই বিষাদের হয়ে উঠে তিনি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। একদিকে তিনি হত্যার মতো অপরাধ করছেন। আবার নিজেও আত্মহত্যা করছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, আত্মহত্যাই সমাধান নয়। কেবল আত্মহত্যা করলেই এই সমস্যার সমাধান হয় না। আত্মহত্যার পেছনে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা সবারই দায় সমানভাবে আছে। তাই যেসব কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে সেসব কারণ শনাক্ত করে সমাধান করতে হবে। বিশেষ করে পারিবারিক নানা কারণে আত্মহত্যা করেন অনেকে। তাই যারা বেশি অভিমানি, যারা কথায় কথায় আত্মহত্যার হুমকি দেয় তাদের বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলা, আর্থিক বা আইনগত ঝামেলা, দীর্ঘস্থায়ী ব্যর্থতা বা মানসিক চাপে পড়ার মতো সমস্যায় পড়লে মানুষের জীবনে নেমে আসে চরম হতাশা। আর সেই হতাশা মারাত্মক পর্যায়ে গেলে মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকে। প্রচ- মানসিক আঘাত পেলেও কিংবা কোনো মারাত্মক শারীরিক সমস্যা ধরা পড়লেও অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া কিছু মানসিক সমস্যাতেও এ প্রবণতা দেখা দেয়। গবেষণা বলছে, যারা আত্মহত্যা করেন, তাদের বড় একটি সংখ্যা বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকেন। বিশেষ করে বিষন্নতা বা ডিপ্রেশনে ভোগা রোগীরা বেশির ভাগ আত্মহত্যা করেন। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক শারীরিক সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল রোগ, ক্যান্সার বা শরীরের অঙ্গহানি থেকে সৃষ্ট মানসিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। এমনকি মানসিক চাপের কারণেও এমনটি হয়। শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের ইতিহাস, অ্যালকোহল বা মাদকে আসক্ত, অতিরিক্ত সামাজিক চাপ ইত্যাদির কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়।
বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ২০২৩ সালে দেশে ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এরমধ্যে ৩০৯ জনই নারী শিক্ষার্থী। স্কুল শিক্ষার্থী ২২৭ জন যা ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ। কলেজ শিক্ষার্থী ১৪০ জন যা ২৭ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৯৮ জন যা মোট সংখ্যার ১৯ দশমিক ১ শতাংশ, এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ৪৮ জন যা ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২২ সালে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী ছিল ৫৩২ জন। আত্মহত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল অভিমান। এরপরেই প্রেমঘটিত কারণ, মানসিক সমস্যায় জর্জরিত, পারিবারিক কলহ, পড়াশোনার চাপ, পরীক্ষায় অকৃতকার্য, কাক্সিক্ষত ফলাফল না পাওয়া, যৌন হয়রানির শিকার, অপমানবোধ হয়েও আত্মহত্যা করছেন অনেকে।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা ঠেকাতে আঁচল ফাউন্ডেশন বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছে। সেগুলো হলো- স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি মাসে অন্তত একবার করে মেন্টাল হেলথ স্ক্রিনিং করা। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে মেন্টর নির্ধারণ করা এবং মেন্টর ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরির পদক্ষেপ নেয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে মেন্টাল হেলথ কর্নার চালু করা। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিষয়াদি অন্তর্ভুক্তকরণ। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ট্যাবু ভাঙতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রচারণা কার্যক্রম চালু করা। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আবেগীয় অনুভূতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতার পাঠ শেখানো। যেকোনো নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে শিক্ষার্থীদের কৌশল, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং মানসিক বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে শেখানো। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পরিবারের সদস্যদের আত্মহত্যা সতর্কতা চিহ্ন সম্পর্কে ধারণা বিস্তৃত করা। এতে সম্ভাব্য আত্মহত্যাকারীকে বাঁচানো যাবে। মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলো ইন্স্যুরেন্সের আওতায় আনা যেন, তা সবার জন্য সাশ্রয়ী হয়। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে একটি টোল ফ্রি জাতীয় হটলাইন নম্বর চালু করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ যে সংকট বা কারণগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তা না করে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। সাম্প্রতিক আত্মহত্যার ঘটনা প্রকাশ করে যে, পারিবারিক কলহ ও সম্পর্কগত দূরত্ব, তরুণদের মধে্য সম্পর্কের কারণে মান-অভিমান, সমাজ নিজের ও পরিবারের সদস্যদের সামাজিক পরিচয় ও অবস্থান তৈরিতে ব্যর্থতাসহ আর্থিক কারণেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। পরিবার ও সমাজে সম্প্রীতি বজায় রেখে চলার মতো ব্যবস্থা ও সেবা না থাকায় নানাবিধ সংকটাপন্ন মানুষ আত্মহত্যাকে মুক্তির উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছে। এই অবস্থার দায় প্রায় সকলের। কারণ সমাজব্যবস্থা ও সম্পর্কের কাঠামো কারও কারও জন্য অসহনীয় হয়ে পড়ছে। সমাজ কাঠামোর মধ্যে পরস্পর সহনশীলতা ও আস্থার সংকট থাকলে বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে অসমর্থ মানুষের জন্য নিঃশেষ হওয়াই শেষ পরিণতি।
মনোবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান বলেন, গোটা সমাজটা অসুস্থ। এই সমাজে কোনো মানুষ সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারে না। গরিব মানুষের থাকে আর্থিক সমস্যা। পরিবার চালানো থেকে শুরু করে ওষুধের খরচ, সন্তানের জামাকাপড়, লেখাপড়ার খরচ থাকে না। নানা সমস্যায় জর্জরিত সমাজের মানুষ। যখন এসব সমস্যা সহ্যের বাইরে চলে যায় তখনই সন্তানকে হত্যা করে নিজে হত্যার মতো ঘটনা ঘটে। অনেক সময় তুচ্ছ ঘটনাগুলো মেনে নেয়ার মতো মানসিকতা অসুস্থ পরিবেশের মধ্যে মানুষের মধ্যে থাকে না। তিনি বলেন, এই সমাজে অনৈতিকতা, মিথ্যাচার, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে পুর্ণাঙ্গ আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটাতে হবে। মানুষের চিন্তাধারা, আচার, আচরণে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। তবে এটা একদিনে সম্ভব না।