নারায়ণগঞ্জে ইটভাটার ছড়াছড়ি, বাড়ছে পরিবেশ দূষণ

নারায়ণগঞ্জে ইটভাটার ছড়াছড়ি, বাড়ছে পরিবেশ দূষণ

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি:
ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি মানবজীবন পড়েছে হুমকির মুখে। শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা আর ধলেশ্বরী নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জে শত শত ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়েই চলছে। এর চুল্লির কালো ধোঁয়ায় দিন যেন রাতে পরিণত হয়। এই বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট ও চর্ম রোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন লাখো মানুষ। নারায়ণগঞ্জে এমন পরিবেশ দূষণে অনেকে আছেন মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।

বায়ু দূষণের এহেন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অনেক আগেই অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। এক দিকে অভিযান করে এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করছে পরিবেশ অধিদপ্তর। অন্যদিকে আবার চলতে দেখা যাচ্ছে এসব অবৈধ ইটাভাটা।

বায়ুদূষণের ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার সব অবৈধ ইটভাটা ভেঙে ফেলার নির্দেশ ছিল হাইকোর্টের। এরপর সারা দেশের অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশও দেওয়া হয়। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের অসংখ্য অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। সেগুলোতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযান পরিচালনা করলেও ধ্বংস হয়নি। বন্ধ হয়নি ভাটার চুল্লি ও চিমনি। ফলে বায়ু দূষণের মাত্রাই বেড়েই চলছে।

পরিবেশ দূষণের বিষয়ে কোনো রকম তোয়াক্কা না করে আইন অমান্য করে অনেক ইটভাটা অবৈধভাবেই পরিচালনা করে আসছে। এর ধারাবাহিকতায় নারায়ণগঞ্জ জেলায় একের পর এক অভিযান পরিচালনা করে ইটভাটার বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এমনকি অনেক ইটভাটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আবার কোনো কোনো ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, বন্দর, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও ও আড়াইহাজারের বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে সারিসারিভাবে গড়ে উঠেছে কয়েকশো ইটভাটা। সনাতন পদ্ধতির এসব ভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত চুল্লি থেকে নির্গত বিষাক্ত কালো ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে মিশে প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করছে। জমিতে ফসল হচ্ছে না, ফলজ গাছ মরে যাচ্ছে। পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরের পর বছর ভুগছে শিশুসহ নানা বয়সের মানুষ।

ফতুল্লার বক্তাবলী এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার বলেন, ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় আমরা দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। বিশেষ করে শিশুদের জ্বর, ঠাণ্ডা, সর্দি, কাশি তাদের লেগেই থাকে। এদের থেকে আমরা কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। আমরা এর প্রতিকার চাই।

ধামগড় এলাকার মো. আরিফ জানান, বাড়ির পাশেই ইটভাটা। আর কিছু সামনেই রয়েছে বাচ্চাদের স্কুল। তারপরও কীভাবে এই অবৈধ ইটভাটা এখানে পরিচালনা করা হয়। ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় আমাদের শরীরে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। একদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান করে বন্ধ করে দিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে আবার এই ইটভাটা চালু হয়ে যাচ্ছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই অতিদ্রুত এই অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে আমাদের স্বাভাবিকভাবে জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা হোক।

মদনপুর এলাকার আছমা বেগম বলেন, বাড়ির ভেতর কোনো কিছু পরিষ্কার করে রাখা যায় না। ইটভাটার ধোঁয়া আর ধূলাবালিতে সব নোংরা হয়ে যায়। আমাদের শ্বাঃস নিতে কষ্ট হয়। ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় কারণে অনেক দিন ধরে শ্বাস কষ্টে ভুগছি। আমরা এই অবৈধ ইটভাটা বন্ধের দাবি জানাচ্ছি। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে ২৪৪টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ১৩০টির অধিক অবৈধ ইটভাটা আদালতে রিট মামলা পরিচালনা করে কার্যক্রম চালু রেখেছে। জেলায় ইটভাটার লিভ টু আপিল রয়েছে ৭৯টি। মোট ২৮টি ইটভাটার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে।

এ ছাড়া যেসব ইটভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র ও ইট পোড়ানোর লাইসেন্স উভয় নেই, এরূপ ৪২টি ইটভাটাকে অবৈধ চিহ্নিত করে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সদর উপজেলার ফতুল্লায় ১২টি ইটভাটাকে ৮১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকটি ইটভাটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বন্দর উপজেলায় ৩৪টি ইটভাটাকে ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সর্বশেষ অভিযানে আড়াইহাজার উপজেলায় নিউ ব্রিকস ম্যাশন নামে ইটভাটাকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সেই সঙ্গে এসব ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬টি ইটভাটার বিভিন্ন স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

সদর, বন্দর ও আড়াইহাজার উপজেলায় অভিযানে মোট ৪৭টি অবৈধ ইটভাটাকে মোট ২ কোটি ৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর পর থেকে নারায়ণগঞ্জে আর কোনো অবৈধ ইটভাটায় পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান পরিচালনা করা হয়নি।

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি রফিউর রাব্বী বলেন, দীর্ঘ ইটভাটার কারণে যেমনই বায়ু দূষণ হচ্ছে, তেমনই ওইসব এলাকার নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবেশ বাঁচানোর দায়িত্বে যারা আছেন তারা সঠিকভাবে কাজ করছেন না। অবৈধ ইটভাটাগুলোকে ধ্বংস না করে দায়িত্বের অবহেলা করছেন। আমরা বিভিন্ন সময় লক্ষ্য করি এই অবৈধ ইটভাটার সঙ্গে জেলা প্রশাসনের অর্থনৈতিক একটা লেনদেন আছে। যার ফলে এগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হচ্ছে না। দায়িত্ব অবহেলাকারীদের পরিবর্তনসহ প্রশাসনকে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

অবৈধ ইটভাটার কারণে পরিবেশ দূষণ চান না ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি। ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি শওকত আলী জানান, সব ইটভাটার মালিকদের বলে দিয়েছি সরকারের সব ধরনের বিধি-নিষেধ মেনে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। অবৈধ ইটভাটা এদেশে কেউ চালাতেও পারবে না এবং কেউ সমর্থনও করবে না। অত্যাধুনিক ও বিকল্প প্রযুক্তির ব্যবস্থা বাস্তবায়নে প্রশাসনের সহযোগিতা চান তিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলার সহকারী পরিচালক শেখ মুজাহিদ বলেন, বায়ু দূষণ রোধের অভিযান এ বছরও চলমান আছে। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে জেলা কার্যালয়ের দূষণ নিয়ন্ত্রণে যে অভিযান তা অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১০১ দিনের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।

যেখানে অবৈধ ভাটাসহ কলকারখানার মাধ্যমে বায়ুসহ পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, সেখানে এ অভিযান চলবে। এ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলার সদর ও বন্দর উপজেলায় ৪ দফায় অভিযান পরিচালনা করে যথাক্রমে ১২, ১৫, ১৯ ও ১টি ইটভাটাকে জরিমানা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জে ২৪৪টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ইটভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র ও ইট পোড়ানোর লাইসেন্স উভয় নেই এরুপ ৪২টি ইটভাটাকে অবৈধ চিহ্নিত করে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পরিবেশ দূষণ রোধের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সদর, বন্দর ও আড়াইহাজার উপজেলায় মোট ৪৭টি অবৈধ ইটভাটাকে মোট ২ কোটি ৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

পরিবেশ বাঁচাতে দ্রুত অবৈধ ইটভাটা ভেঙে ফেলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি সমাজ বিশ্লেষকদের।

এআর-১৯/০৪/২৪

Share your comment :