নারী নির্যাতন দমনে নতুন আইন আসছে
নিজস্ব প্রতিবেদক:
নারী নির্যাতন দমনে নতুন আইন আসছে। এ আইনের খসড়ায় ‘শিশু’ শব্দ বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ধর্ষণের সংজ্ঞায়ও আসবে পরিবর্তন। বিশ্বের অনেক দেশের সমসাময়িক বাস্তবতায় যৌন নিপীড়ন ও বিকৃত যৌনাচারকে ধর্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর আলোকে খসড়ায় ধর্ষণের সংজ্ঞা সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে। আইনটির ব্যাপারে এরই মধ্যে চাওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন অংশীজনের মত।
গত মঙ্গলবার মাঠ পর্যায় ও নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তাদের মত জানতে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক করে ঢাকা মহানগর পুলিশ। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার ওই বৈঠকে ডিএমপি কমিশনার ছাড়াও অতিথি হিসেবে একাধিক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। নতুন আইনের ব্যাপারে পুলিশ তাদের বেশ কিছু মত তুলে ধরে। তা পুলিশ সদরদপ্তরের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। পুলিশের প্রস্তাবে এ আইনে তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) নাগরিকের বিচার পাওয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট একটি ধারা যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে তৃতীয় লিঙ্গের কেউ ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে মামলার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। তাদের পরিচয়ের ব্যাপারে এ আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, নতুন আইনে তৃতীয় লিঙ্গের বিষয়টি যুক্ত করার যে প্রস্তাব, এটি ইতিবাচক। বিভিন্ন সময় আমরাও এমন দাবি করেছিলাম। নতুন আইনের পাশাপাশি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার সাপোর্ট সার্ভিসগুলো আরও কার্যকর করতে হবে। বিচার পাওয়ার দীর্ঘসূত্রতা দূর করা জরুরি।
ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, পুলিশ মাঠ পর্যায়ে যেসব সমস্যায় পড়ে, সেসবই নতুন আইনে যুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। সবার সুপারিশসহ এটি মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় কমিটিতে যাবে। এর পর ভেটিং হবে। নতুন আইন পাস হলে বর্তমানের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন রহিত হবে। তবে পুরোনো মামলার বিচার এ আইনে চলবে।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২০ হাজার মামলা হয়। এর মধ্যে থানায় হয় ১৮ হাজার ৯৪১টি। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৩৮টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ৩৪ হাজার মামলায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচার চলছে।
ধর্ষণের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে নতুন একটি ধারণা যুক্ত করার ব্যাপারে মতামত দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের যুক্তি হলো, এখন ধর্ষণের অনেক মামলার এহাজারে ভুক্তভোগী লেখেন– বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। ভুক্তভোগীর বয়স ১৬ বছরের অধিক বা কেউ বিবাহিত হলেও এজাহারে এ বিষয়টি লেখা থাকে। অনেক ঘটনায় এমন নজির পাওয়া যায়– ছেলে-মেয়ে উভয়ের মধ্যে দীর্ঘদিন প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল ছেলে। মেয়ের সম্মতিতেই তাদের শারীরিক সম্পর্ক ছিল। এর পর মেয়ে বিয়ের জন্য চাপ দিয়ে থাকলে বিভিন্ন অজুহাতে তা এড়িয়ে যায় ছেলে। এমন বাস্তবতায় ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করছে নারী। সম্পর্কের সূত্র ধরে সম্মতি নিয়ে শারীরিক সম্পর্কের ঘটনায় ধর্ষণের যে মামলা হয়, আদালতে গিয়ে তা ধর্ষণ বলে প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যায়। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একাধিক রায়ে বলা আছে, ১৬ বছরের ঊর্ধ্বে কোনো নারীর সম্মতিতে তাঁর সঙ্গে কারও শারীরিক সম্পর্ক হলে সেটিকে ধর্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এসব রায়ে আদালত বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগও খারিজ করেছেন। ভারতের উচ্চ আদালতও বিভিন্ন সময় বলেছেন, কোনো নারী স্বেচ্ছায় দীর্ঘদিন ধরে কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখার পর ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ আনতে পারবেন না।
নতুন আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রায়ই দেখা যায়, বাসাবাড়িতে কাজে সাহায্যকারী নারী ও শিশুদের ওপর গৃহকর্ত্রীরা গরম পানি, তেল বা গরম খুন্তি দিয়ে নির্যাতন করে। এটি নারী বা শিশুর যে কোনো শারীরিক বিকৃতি, অঙ্গহানি বা দৃষ্টিহানি ঘটাতে পারে। বর্তমান আইনে বাসার সাহায্যকারীর ওপর সংঘটিত অপরাধের বিচার করা কঠিন হতে পারে। কাজেই প্রস্তাবিত আইনে কোনো তীব্র জ্বালাদায়ক দহনকারী তরল পদার্থ বা ধাতব বস্তুর কথা সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান আইনে অপহরণের চেষ্টা এবং অপহরণের পর হত্যার অপরাধের দণ্ডের কথা বলা নেই। অপরাধের শিকার নারীর সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত আইনে নারী অপহরণ এবং অপহরণ চেষ্টার শাস্তি, অপহরণের পর অপহৃত নারীকে হত্যার জন্য শাস্তি এবং অপহরণকারীর হেফাজতে থাকাকালীন অপহৃত নারীর মৃত্যু ঘটানোর শাস্তির বিধান সংযুক্তি করা হয়। বর্তমান আইনে অপরাধের শাস্তি কিছুটা অসংগতিপূর্ণ বলে মত এসেছে। প্রস্তাবিত আইনে সচেতনভাবেই কারাদণ্ডের অন্যূন মেয়াদ বলা হয়নি, যাতে বিচারকরা ঘটনার প্রেক্ষাপটে শাস্তির মেয়াদ নির্ধারণ করতে পারেন।
প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, মামলার তদন্ত কর্মকর্তার অবহেলা, ধর্ষণের শিকার নারীর চিকিৎসা, আলামত সংগ্রহ এবং গোপনীয়তা রক্ষায় ফরেনসিক পরীক্ষায় অহেতুক দেরি হলে জড়িতরা দায়বদ্ধ থাকবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এ ধরনের বিধান ইতিবাচক। এতে দ্রুত তদন্ত শেষ করা সম্ভব হবে।
এআর-১৫/০৫/২৪
Share your comment :