পিতৃপরিচয় আর ভারতবিরোধিতার কারণে আমাকে গুম করা হয়েছিল: আযমী
বাংলাকণ্ট রিপোর্ট:
দীর্ঘ আট বছর গুপ্ত বন্দিশালা আয়নাঘরের অন্তরাল থেকে ফিরে জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত কেন্দ্রীয় আমির গোলাম আযম পুত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল্লাহিল আমান আযমী নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেছেন, আমাকে দুইটা কারণে আটকে রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো, আমার পৈতৃক পরিচয় এবং আমি ভারতের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম।
তিনি বলেন, আমি সব প্রতিবেশী বন্ধু চাই। যে বন্ধু আমার ক্ষতি করে তাকে শত্রু ছাড়া আমি বন্ধু ভাবতে পারি না। ভারত যতদিন বন্ধুসুলভ আচরণ করবে ততদিন আমি বুকে জড়িয়ে ধরব। ভারত যদি শত্রুর মতো আচরণ করে তাহলে আমি তাকে শত্রুই ভাবব এবং শত্রু বলে যাব। গুপ্ত বন্দিশালাতে থাকাকালীন আমাকে একজন বলেছেন, আপনি বিদেশি শক্তির গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। এ কারণে আমাকে বারবার প্রশ্ন করা হয়েছে, আপনি ভারতের বিরুদ্ধে সোচ্চার কেন?
মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম জুমে যুক্ত হয়ে এসব কথা বলেন আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।
দীর্ঘদিন বন্দি থাকা অবস্থায় দাঁত, চোখসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা। রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থা থেকে সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত হন তিনি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের যারা আহত ও নিহত হয়েছেন তাদের প্রতি শোক, কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা জানান তিনি।
একইসঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদের প্রকৃত সংখ্যা ও জাতীয় সঙ্গীতের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে জাতীয় সঙ্গীত ও সংবিধান পরিবর্তনের দাবি তুলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, আমি এই জাতীয় সঙ্গীত বর্তমান সরকারের ওপর ছেড়ে দিলাম। আমাদের এখন যে জাতীয় সঙ্গীত রয়েছে, সেটি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি। এটা দুই বাংলা এক করার জন্য বঙ্গভঙ্গ রদের সময়কে উপস্থাপন করে। যে সঙ্গীত দুইবাংলা এক করার জন্য করা হয় সেটা কীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হতে পারে? এই সঙ্গীত ১৯৭১ সালে ভারত আমাদের উপরে চাপিয়ে দিয়েছিল। জাতীয় সঙ্গীত করার জন্য অনেক গান রয়েছে। এই সরকারের উচিত একটা নতুন কমিশন গঠন করে একটি নতুন জাতীয় সঙ্গীত তৈরি করা।
সংবিধানে কী ধরনের পরির্তন বা সংস্কার চান, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংবিধান পরিবর্তন করা একটা বিরাট ব্যাপার। সংবিধানে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে অন্যায় হলে আইনের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নাই, এটা বাতিল করতে হবে। মানবাধিকার পরিপন্থি যতগুলো আইন আছে এগুলো সব বাতিল করতে হবে। নতুন করে সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এদেশের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের আবেগের প্রতিফলন হতে হবে। আমাদের দেশ হচ্ছে একটি মুসলিম রাষ্ট্র। এখানে প্রায় ৯০ ভাগের বেশি মুসলমান রয়েছে। মুসলমানদের আল্লাহর আইনের বিরোধী কোনো সংবিধান থাকতে পারবে না। আমাদের সংবিধানে লেখা আছে জনগণ সার্বভৌমত্বের মালিক। কিন্তু জনগণ সার্বভৌমত্বের মালিক নয়। সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহর আইনের বিরোধী কোনো আইন পাস হতে পারে না। জনগণ সার্বভৌমত্বের মালিক হতে পারে না। সুতরাং সংবিধানে একটা আইন সংযোজন করে আমাদের মুসলিম চেতনার আইন করতে হবে।
বেআইনিভাবে আটকে রাখার ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, আমি কোনো আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করব কি না, এ বিষয়ে যদি বলি, সেনাপ্রধান নিজে একটা কমিটি করেছেন। তাদের সাথে আমার চার ঘণ্টা কথা হয়েছে। অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা আামকে বলেছেন, তারা সত্য উদঘাটন করবেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই সেনাপ্রধান সত্য উদঘাটন করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।
রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে আযমী বলেন, আমি এখনো চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছি। রাজনীতি নিয়ে আমি কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা করিনি। আমি দেশপ্রেমিক, আমি দেশের জন্য কাজ করতে চাই। আল্লাহতায়ালা যেন আমাকে দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ দেন এবং সাহায্য করেন।
বর্তমান সরকারকে দ্রুত নির্বাচনের জন্য চাপ না দেওয়াসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন এবং বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের ৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদের মতো নানা পদবিতে ভূষিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
আযমির ভাষ্যমতে, ২০১৬ সালে গুমের শিকার হন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযামের সন্তান আবদুল্লাহিল আমান আযমী। দীর্ঘ ৮ বছর পরে গত ৬ আগস্ট দিবাগত রাতে তিনি আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়েছেন। সেদিন ভোরেই তাকে মুখোশধারী কয়েকজন লোক গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয় টাঙ্গাইলের ঘাটাইল এলাকা থেকে। নামিয়ে দেওয়ার পর তার হাতে পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দেন মুখোশধারীরা। এরপর তিনি ঢাকাগামী একটি বাসে উঠে এক যাত্রীর মোবাইল থেকে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরিবারের লোকজন তাকে ঢাকার টেকনিক্যাল মোড় থেকে বাসায় নিয়ে যান। বাসায় নেওয়ার একদিন পরে আযমী অজ্ঞান হয়ে যান। তারপর থেকে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে তার মন্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান কোনো রকম জরিপ ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা প্রকাশ করেন। একটা যুদ্ধে কত মানুষ মারা গেলেন তার কোনো সঠিক সংখ্যা জাতি এখনো জানে না।
শহীদের সংখ্যা নিয়ে একটি জরিপ হয়েছিল উল্লেখ করে ব্রিগেডিয়ার আযমী বলেন, একটা জরিপ হয়েছিল যেখানে ২ লাখ ৮৬ হাজার শহীদের সংখ্যা জানা গেলেও শেখ মুজিবুর রহমান ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলেন।
সংবাদ সম্মেলন শেষ করার আগে কয়েকটি দাবি তুলে ধরেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল্লাহিল আমান আযমী। গুম ও হত্যা বন্ধ করা; সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং নতুন জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
এএ/
Share your comment :