বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির জন্য হাহাকার

বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির জন্য হাহাকার

রাজশাহী প্রতিনিধি:

শুকিয়ে খা খা করছে পদ্মা। অন্য নদীগুলোও মৃত প্রায়। খাল-বিলসহ এখন নদীতেও মাছের বদলে চাষ হচ্ছে ধান-গম-ভুট্টার মতো ফসল! একদিকে নদীতে পানি নেই, অন্যদিকে বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ক্রমশই নিচে নামছে। প্রতি বছর চৈত্রের খরতাপ শুরু হওয়ার আগেই রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির তীব্র সংকট দেখা যায়। এখানকার উঁচু এলাকাগুলোয় পানির সংকটের চিত্র ভয়াবহ। এবারও রাজশাহী জেলাসহ আশপাশের জেলাগুলোয় পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

চলমান তাপপ্রবাহ ও তীব্র খরার মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে অবস্থান করছে। পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে হাহাকার উঠেছে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে। নিজ এলাকায় পানিস্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি বিশেষ পোস্ট দিয়েছেন রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি লিখেছেন, ‘বাঘা-চারঘাট এলাকায় পানি পেতে সমস্যা হচ্ছে মানুষের। এরপরও গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে। অতিরিক্ত পুকুর খনন করে গভীর নলকূপ বসিয়ে পুকুরে পানি ভরা হচ্ছে। এলাকায় পানিস্তর দ্রুত নেমে যাওয়ার এটা বড় কারণ বলে আমার মনে হচ্ছে।’
সরকারের সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীর পোস্টে মন্তব্য লিখেছেন কয়েকশ মানুষ; যারা নিজ নিজ এলাকার পানি সংকটের কথা তুলে ধরেছেন। এমনি একজন হলেন মাহাবুবুর রহমান। তিনি তার পোস্ট মন্তব্য লিখেছেন, পুঠিয়া উপজেলাধীন ৩ নম্বর বানেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদ, ৪ নম্বর ওয়ার্ড, শিবপুরহাট জায়গিরপাড়া এলাকার কোনও টিউবওয়েল থেকে পানি উঠছে না। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষি জমির সেচ কার্য ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। খাবার পানি ও সেচ কার্যের পানি পুরোটাই মোটর পাম্প নির্ভর হয়ে পড়েছে।

যেসব জায়গায় সংকট প্রবল
রাজশাহীতে পানি নিয়ে কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডাকসো ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনের পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট এবং শিবগঞ্জ উপজেলার পানির স্তর তুলনামূলকভাবে ভালো। সদর উপজেলার রানিহাটি ইউনিয়নে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে। মহারাজপুর ইউনিয়নেও আংশিক এলাকায় আর্সেনিক আছে। তবে সদরের ঝিলিম ইউনিয়ন, গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর, রহনপুর ও পার্বতীপুর ইয়নিয়ন এবং নাচোল উপজেলার সবকটি ইউনিয়ন চরম পানি সংকটাপন্ন এলাকা। রাজশাহী জেলার পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ গোদাগাড়ী উপজেলার বাসুদেবপুর ও মাটিকাটা ইউনিয়ন ছাড়া সবগুলোর একুইফার আশঙ্কাজনক। তানোর উপজেলার পাচন্দর, মুণ্ডুমালা, কলমা ও বাধাইড় ইউনিয়নে অনেক জায়গায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

পানি আইন ২০১৩’র নির্দেশনা অনুসারে এনজিও ডাসকো, সুইস রেডক্রস, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ত ৯ বছর ধরে সুইজারল্যান্ড দুতাবাসের সহায়তায় যে সমীক্ষা চালিয়েছে তার ফলাফল তুলে ধরে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা ৫০০ মিটার বা ১৬০০ ফুট পর্যন্ত বোরিং করে মাত্র একটা একুইফার (ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তর) পেয়েছি। যার পুরুত্ব ৫০ থেকে ৬ ফুট। অর্থাৎ আনুপাতিকহারে ভাল এলাকাইয় পুরুত্ব ৫০ ফুটের মতো। আর খারাপ এলাকায় কমতে কমতে তা ৬ ফুটে এসে ঠেকেছে। তবে রাজশাহী জেলার পবা, মোহনপুর, বাগমারা, দুর্গাপুর এবং পুঠিয়ার অবস্থা কিছুটা ভালো। বাঘা চারঘাটের অবস্থাও খুব ভালো নয়।

জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, মাটির নিচের পানি তুলে এখন পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে। একুইফার (ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তর) একবার শুকিয়ে গেলে চাষ তো দূরের কথা, খাবার পানি পর্যন্ত পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যেখানে আইন করে গ্রাউন্ড ওয়াটার তোলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পানির অভাবে নওগাঁর পোরশা, সাপাহার ও নিয়ামতপুরের মানুষ আমবাগান করছে, আর আনন্দে তাদের এলাকাকে আমের রাজধানী ঘোষণা করতে চাইছে। কিন্তু খেয়াল করে দেখেন ৫ বছর আগেও তারা আমন, আউশ, বোরো করত। ৫ হাজার হেক্টর আমবাগান এখন ৪০০ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে গেছে। এভাবে আমের বাগান বাড়লে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, ধান চাষ কমে যাওয়ার কারণে অনেক গ্রামে গিয়ে আর গবাদিপশু দেখা যায় না। ফলবাগান হলে সেখানে কোনও ধরনের শস্য হওয়ার সুযোগ থাকে না। মাত্র এক মাসের আমের জন্য আমরা সারা বছর আবাদযোগ্য ফসলের জমি হারাচ্ছি। আবার বিপুল পরিমাণ কৃষিশ্রমিক বিশেষ করে আদিবাসিরা তাদের কাজ হারাচ্ছে। শুধু ফল ফসল বলেই নয়, পানির অভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক পরিবেশগত ক্ষতি হতে চলেছে যা আমরা হয়ত বুঝতে চাইছি না।

জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, রাজশাহী ওয়াসা ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প করে পদ্মা নদীর গোদাগাড়ী পয়েন্ট থেকে খাবার পানি আনার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এটার চেয়ে জরুরি ছিল এমন প্রকল্প করে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি বাঁচানো। রাজশাহী শহরের একুইফার খুব ভালো এবং প্রতিবছর বর্ষায় তা রিচার্জ হয়। নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যারা কাজ করেন, এ অঞ্চলের পানির বিষয়ে খুব দ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সময় পার হয়ে গেলে হাজার চেষ্টা করেও মৃত একুইফারকে জীবিত করা যাবে না।

ওয়াসার প্রকল্পে ‘থাকবে না’ সংকট
এদিকে রাজশাহী ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা নদীর গোদাগাড়ী পয়েন্ট থেকে খাবার পানি আনার প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ১ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। আড়াই থেকে তিন শতাংশ সুদে হুনান কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ২ হাজার ৩১৩ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয় করবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময়সীমা চার বছর।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের সারেংপুর এলাকায় পদ্মা নদীর যে স্থানে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটি স্থাপন করা হবে সেখানেই ভারত থেকে গঙ্গা নদী বাংলাদেশে ঢুকে পদ্মা হয়েছে। এখান থেকেই আবার পদ্মার শাখা নদী হিসেবে বেরিয়ে গেছে মহানন্দা। দুই নদীর মোহনায় ওয়াসার এই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হবে। সারা বছর এখানে অন্তত ৩০ ফুট গভীর পানি থাকে। প্রকল্প গ্রহণের আগে স্থানটির সারা বছরের পানির গভীরতা নিয়ে ৩০ বছরের পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করেছে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম)। এরপরই সেখানে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজশাহী ওয়াসা।

রাজশাহী ওয়াসা জানায়, রাজশাহী শহরে এখন প্রতিদিন পানির চাহিদা ১১ কোটি ৩২ লাখ লিটার। চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন পাম্পের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ ৮ কোটি ৬৫ লাখ লিটার পানি তোলা হয়। আর এখন মাত্র ৯০ লাখ লিটার ভূ-উপরিস্থ পানি পরিশোধন করা হয়। তাও প্রতিদিন ১ কোটি ৭৭ লাখ লিটার পানির ঘাটতি থেকে যায়। নতুন প্ল্যান্ট হলে ঘাটতি থাকবে না। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে এ প্রকল্পের খসড়া সম্পন্ন করা হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদন হয়। পরে একই বছরের অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় প্রকল্পটি পাস হয়। এরপর নানা সমীক্ষা চলছিল। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পরই চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এখন কাজ শুরু হয়েছে।

রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকীর হোসেন বলেন, গোদাগাড়ী উপজেলার সারেংপুরে সারা বছর পদ্মায় পানি থাকে বলে জায়গাটি নির্ধারণ করা হয়েছে। স্থান নির্বাচনের আগে আইডব্লিউএম ৩০ বছরের পানির পরিসংখ্যান নিয়ে সমীক্ষাও চালিয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে রাজশাহী শহরে আর পানির ঘাটতি থাকবে না। শহরের চাহিদা মিটিয়ে রাজশাহী ওয়াসা আশপাশের পৌর এলাকাগুলোতেও সুপেয় সরবরাহ করতে পারবে।

টিউবওয়েলে পানি ওঠে না

রাজশাহী বিভাগীয় জনস্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, আশি ও নব্বই এর দশকে রাজশাহী অঞ্চলের গ্রাম জনপদে হাজার হাজার হস্তচালিত নলকূপ স্থাপন করা হয় যেগুলো পানি চাহিদা মেটাতে। এমন কয়েক লক্ষাধিক হস্তচালিত নলকূপে এখন আর পানি ওঠে না। ভূ-গর্ভস্থ পানি স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপই এখন প্রায় পরিত্যক্ত। ক্রমাগত পানি চাহিদা সংকট মেটাতে এখন গ্রামাঞ্চলে সাবমারসিবল পাম্প বরাদ্দ ও স্থাপন করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জল মোটর দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই নিজের টাকায় জল মোটর স্থাপন করছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, রাজশাহী মহানগর এলাকায় ওয়াসার সরবরাহ করা পানি পেয়ে থাকেন এলাকাবাসী। রাজশাহী মহানগর এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনে ব্যবহার করা হচ্ছে উচ্চ ক্ষমতার পানির পাম্প। এর বাইরে নগরীতে ব্যক্তি উদ্যোগে ৬ হাজারের বেশি সাবমারসিবল পাম্প রয়েছে।
রাজশাহী নগরীতে থাকা হস্তচালিত নলকূপগুলো থেকে এখন আর কোনও পানি পাচ্ছেন না নগরবাসী। অন্যদিকে রাজশাহী অঞ্চলের গ্রাম জনপদে থাকা হস্তচালিত নলকূপেও কোনও পানি উঠছে না।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুণ্ডুমালা পৌরসভার মেয়র সাইদুর রহমান জানান, শুষ্ক মৌসুমে বরেন্দ্র এলাকায় পানির সংকট বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে এলাকার মানুষের পানির প্রাপ্তির প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ ও পুকুর। তাও লোকজনকে অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। পানি সংগ্রহের কষ্টটাই এখন এলাকার মানুষের কাছে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, এপ্রিল-মে মাসে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রাম জনপদে ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে যায় প্রতি বছর। গত কয়েক বছর ধরে এমনটা দেখা যাচ্ছে। এ বছর পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে উঠেছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে রাজশাহী অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা ঊর্ধ্বে ৪০ এবং নিম্নে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। এই সময়ে বরেন্দ্রভুমির মাঠ ঘাট পুকুর জলাশয় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) নামের একটি পানি গবেষণা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, রাজশাহীর পাঁচন্দর ইউনিয়ন হচ্ছে দেশের সবচেয়ে উত্তপ্ত এলাকা। এই এলাকায় পানির সংকটও বেশি।
এলাকার বাসিন্দা সাজেদুল ইসলাম বলেন, পানি সংকটের কারণে গরু বাছুর পালন করা কঠিন হয়ে উঠেছে। ১৫০ ফুট বোরিং করেও টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকার পুকুর জলাশয়েও পানি নেই। আর খাওয়ার পানির কষ্ট আরও বেশি। যখন বিদ্যুৎ থাকে তখন বিএমডিএর গভীর নলকূপ চালু হয়। তখন গ্রামবাসী কলস, বালতি, গামলাসহ অন্যান্য পাত্র নিয়ে একযোগে ভিড় করেন পানি সংগ্রহ করতে। কাড়াকাড়ি করে পানি সংগ্রহ করতে হয় গ্রামের শতাধিক পরিবারকে। এক অসহনীয় কষ্টের বিষয়।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, জেলার তানোর উপজেলার মুণ্ডুমালা পৌরসভার মাহালিপাড়া গ্রামের মানুষের এখন পানির সংকট ভয়াবহ আকার নিয়েছে। মাহালিপাড়া বাসিন্দা আদিবাসী ফিলিপ টুডু বলেন, অনেক মানুষে নিজের পয়সায় সাবমারসিবল বসিয়ে পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন। কিন্তু আমরা গরিব মানুষ। একটা সাবমারসিবল বসাতে লাখ টাকা খরচ হয়। আমরা পারি না। বিএমডিএর গভীর নলকূপই আমাদের একমাত্র ভরসা। সারাদিন বিদ্যুৎ বন্ধ থাকলে আমরা নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে বসে থাকি।

রাজশাহীর তানোরের পাশাপাশি গোদাগাড়ীর বরেন্দ্র ভূমির গ্রামগুলোতেও তীব্র পানি সংকট বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। গোদাগাড়ীর ললিতনগর এলাকার বাসিন্দা মনজুর হোসেন বলেন, আগে মানুষ খাওয়ার চিন্তা করতেন। এখন এলাকার মানুষের বড় চিন্তা হয়ে উঠেছে খাওয়ার পানি। পানির অভাবে এলাকাবাসী গরু ছাগল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

এদিকে রাজশাহীর পদ্মা তীরবর্তী গ্রামগুলোর কোনো টিউবওয়েলে পানি উঠছে না বলে জানিয়েছেন বাঘার গড়গড়ি এলাকার বাসিন্দা জায়েদা খাতুন। তিনি বলেন, এপ্রিল মাস শুরু হওয়ার পর টিউবওয়েলে পানি নেই। এক ঘণ্টা চেষ্টা করেও এক বালতি পানি তোলা যাচ্ছে না। এখন প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে পানি এনে খেতে হচ্ছে।
বাঘার উত্তর মিলিক বাঘা গ্রামের নাসির উদ্দীন বলেন, বাড়ির টিউবওয়েলে ১৭০ ফুট পাইপ বসিয়েছি। এরপরেও পানি উঠছে না। বিদ্যুৎচালিত মোটর বসানো আছে, সেখানেও পানি উঠছে না। সংকট ভয়াবহ।
অন্যদিকে তীব্র খরায় বরেন্দ্রভূমিতে বোরো ক্ষেতে সেচ সংকট বেড়ে গেছে। বিএমডিএর গভীর নলকূপগুলো থেকে কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী পানি দিতে পারছে না।

রাজশাহী জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ বলেন, প্রতি বছরই এপ্রিল-মে মাসে বরেন্দ্রের পানিস্তর নেমে যায়। বৃষ্টি হলে তখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। রাজশাহীর আবহাওয়া এখন বেশ উত্তপ্ত। এপ্রিলজুড়ে খরা চলছে। গ্রামাঞ্চলে পানির কিছুটা সংকট আছে বলে আমরা অভিযোগ পাচ্ছি।

বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতি বছর অব্যাহতভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে যাচ্ছে উল্লেখ করে রাবির ভূতত্ত্ব ও খনি বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব রাজশাহী অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে। আবার বৃষ্টি কম হওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারও এজন্য অনেকাংশে দায়ী। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হতে পারে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানো। এতে স্থিতিশীল একটা অবস্থা আসতে পারে।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) মনিটরিং কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম জানান, আমরা গভীর নলকূপের পানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পানির সংকটাপন্ন এলাকায় পানি-নিবিড় বোরো ফসলের বিকল্প হিসেবে কম পানি ব্যবহার করা হয় এমন ফসলের চাষাবাদে উৎসাহিত করছি চাষিদের। সেই সঙ্গে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে সারা বছর যাতে ব্যবহার করা যায় সেদিকও নজর রাখছি।

এআর-১৮/০৪/২৪

Share your comment :