মস্কোয় হামলা: পুতিনের জন্য বড় ধাক্কা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
রাশিয়াকে নিরাপত্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পঞ্চম দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহ না যেতেই গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক প্রাণঘাতী হামলার শিকার হয়েছে দেশটির রাজধানী মস্কো।
মস্কোর ক্রোকাস সিটি কনসার্ট হল ও শপিং কমপ্লেক্সে শুক্রবারের (২২ মার্চ) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট খোরাসান (আইএস)। এ হামলায় এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১৪৩ জন, আর আহত হয়েছেন শতাধিক। এই পরিস্থিতি পুতিনের জন্য কতটা চ্যালেঞ্জের, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীবিষয়ক প্রধান প্রতিবেদক ম্যাথিউ চ্যান্স।
এদিকে রুশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে হামলার জন্য সন্দেহভাজন চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু পুতিনের দাবি, গ্রেপ্তার চারজন ইউক্রেনে পালানোর পরিকল্পনা করছিল। তাদের সঙ্গে ইউক্রেনের যোগাযোগ রয়েছে। তবে এ হামলায় জড়িত থাকার দাবি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে কিয়েভ। মস্কো এই অভিযোগকে আক্রমণ বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে বলেও সতর্ক করেছে কিয়েভ।
তবে আরও হামলার আশঙ্কা থাকায় রাশিয়াজুড়ে প্রধান পরিবহন কেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পাবলিক কনসার্ট ও ক্রীড়া ইভেন্ট স্থগিত করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতির পর স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা, যে উদ্দেশ্যে পুতিনকে রাশিয়ানরা ভোট দিয়েছিলেন তা ব্যর্থ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
রাশিয়ার মতো দেশের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার নিশ্চয়তা দিতে বছরের পর বছর ধরে ক্রেমলিনের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিকেই যোগ্য নেতা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া আজ পুতিনের ২৪ বছরের ক্ষমতার সবচেয়ে অনিরাপদ ও অস্থির সময় পার করছে বলে মনে হচ্ছে।
এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের তৃতীয় বছর চলছে। এতে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে রাশিয়ানদের। সামরিক বাহিনী হতাহতের পরিসংখ্যান প্রকাশ না করলেও মার্কিন তথ্য বলেছে, আনুমানিক ৩ লাখের বেশি রুশ হতাহত হয়েছেন। গত বছর নিযুক্ত অনেক সৈন্যকে এখনো ফ্রন্টলাইন থেকেই সরানো হয়নি। যুদ্ধ যতই এগিয়ে যাচ্ছে, রাশিয়ানদের মধ্যে ভয় বাড়ছে যে নৃশংসতা আরও বাড়তে থাকবে। আরও অনেককে বলি হতে হবে।
ক্রেমলিনবিরোধী ইউক্রেন ভিত্তিক রুশ জঙ্গিগোষ্ঠী ইউক্রেনীয় ড্রোন ও সীমান্ত ক্রস হামলা অব্যাহত রেখেছে। ইউক্রেনীয় ফ্রন্টে রুশ কমান্ডারদের দুর্বল কর্মক্ষমতা ও অস্ত্র সম্পূর্ণরূপে অপ্রত্যাশিত পরিবেশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এতে সামরিক ব্লগার ও সামরিক কট্টরপন্থীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ভিন্নমত দেখা দিচ্ছে।
গত বছর ভাড়াটে গোষ্ঠী ভাগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের বিদ্রোহ ছিল তারই প্রমাণ। ভাগনারের বিদ্রোহ রাশিয়ার ইতিহাসে অন্যতম মর্মান্তিক ও অপমানজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। তবে ঘটনার বেশ কিছুদিন পর নানা নাটকীয়তা শেষে রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এতে করে প্রিগোশিন নামক হুমকি পুতিনের পথ থেকে চিরস্থায়ীভাবে সরে গেলেও অন্যান্য অসন্তুষ্ট কট্টরপন্থীদের আবির্ভাব ঘটতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
একইভাবে, রাশিয়ার বিরোধী নেতা ও পুতিনের কট্টর সমালোচক আলেক্সি নাভালনির সাম্প্রতিক মৃত্যুতে ক্রেমলিনের একজন সোচ্চার সমালোচকের চির প্রস্থান ঘটলো। কিন্তু সেদিন যারা নাভালনির শেষকৃত্যে অংশ নিতে মস্কোতে উপস্থিত হয়েছিলেন কিংবা যারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শেষ দিনে ভোটকেন্দ্রে পুতিনের বিরুদ্ধে মিডডেতে ভোট দিতে বেরিয়েছিলেন, তারা প্রমাণ করেছেন পুতিনের বিরোধীরা এখনো আছেন। তাদের ভিত্তি শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু এখন সব দৃষ্টি চলে গেছে রাশিয়ার বড় ধরনের জঙ্গি হামলার পুনরুত্থানের দিকে যার সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ বা ক্রেমলিনের অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার কোনো সম্পর্ক নেই।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সরকারগুলো মার্চের শুরুতেই এ ধরনের হামলার গোয়েন্দা বার্তায় সতর্ক করেছিল। মার্কিন কর্মকর্তাদের দাবি, তারা কয়েক মাস ধরে রাশিয়াকে গোয়েন্দা তথ্য জানিয়ে আসছেন। কিন্তু কিছু কারণে পুতিন তা উপেক্ষা করেছেন। সতর্কতাগুলোকে ‘উস্কানি… রুশ সমাজকে ভয় দেখানো ও অস্থিতিশীল করার’ অভিপ্রায় হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি। কারণ কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের পর মার্কিন-রাশিয়া সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে রয়েছে বর্তমানে। এমতাবস্থায় পশ্চিমাদের সতর্কবার্তা আমলে না নেওয়াকেও স্বাভাবিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কিন্তু একজন নেতা যে কিনা রুশদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার জন্য রাশিয়ার মাটিতে বড় ধরনের হামলা অনেক বড় ধাক্কা বটে।
এদিকে মস্কোয় হামলার ঘটনায় রোববার (২৪ মার্চ) দেশজুড়ে শোক পালন করেছে রাশিয়া। এ উপলক্ষে দেশজুড়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। এ ছাড়া লোকজন ক্রোকাস সিটি হলে ফুল দিয়ে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। আহত ব্যক্তিদের জন্য হাসপাতালে রক্ত দিতে গত শনিবার থেকে হাজারো মানুষ জড়ো হন। এদিকে এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে কর্তৃপক্ষ।
রাশিয়ার তদন্তকারী সংস্থা বলছে, উদ্ধারকারীরা এখনো পুড়ে যাওয়া ভবন থেকে মরদেহ উদ্ধারে কাজ করছেন। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় নিহত ব্যক্তিদের ২৯ জনের পরিচয় প্রকাশ করেছে।
শনিবার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো সরাতে ও ধ্বংসস্তূপে উদ্ধারকাজ চালাতে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন ‘বর্বর সন্ত্রাসী হামলা’ চালানো সন্ত্রাসীদের শাস্তি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শনিবার টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে পুতিন বলেন, যারা প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, আমি তাঁদের সবার প্রতি আমার গভীর, আন্তরিক সমবেদনা প্রকাশ করছি। পুরো দেশ এবং জনগণ আপনাদের সঙ্গে শোকাহত। সূত্র: সিএনএন
এআর-২৪/৩/২৪
Share your comment :