মুক্তিপণ চূড়ান্ত, ঈদের আগেই মুক্ত হতে পারে জিম্মি ২৩ নাবিক
নিজস্ব প্রতিবেদক
জিম্মি এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ২৩ নাবিককে মুক্ত করতে চূড়ান্ত হয়েছে পণের টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বীমা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জলদস্যুদের সঙ্গে মুক্তিপণের অর্থ নিয়ে দরকষাকষির পর মুক্তিপণের টাকার পরিমান নির্ধারিত হয়েছে। এর ফলে, ঈদের আগেই মুক্তি মিলতে পারে বন্দি ২৩ নাবিকের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানিয়েছে, মুক্তিপণের টাকা নির্ধারিত হলেও তার পরিমান জানা যায়নি। মুক্তিপণ কোন প্রক্রিয়ায় দস্যুদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এরপর ঠিক হবে মুক্তির দিনক্ষণ।
প্রসঙ্গত, ভারত মহাসাগর থেকে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ এবং ২৩ নাবিকের মুক্তিপণ বাবদ ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৫০ লাখ ডলার দাবি করেছিল জলদস্যুরা।
এদিকে জাহাজটির মালিকপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপ থেকে জানা গেছে, ঈদের আগেই জিম্মি নাবিকদের মুক্তির দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে রাখতে চাচ্ছে জাহাজটির মালিকপক্ষ। এই নিয়ে বীমা প্রতিষ্ঠানকে চাপও দিচ্ছে তারা। তবে জলদস্যুরা মুক্তিপণের টাকা পাওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো দিনক্ষণ ঘোষণা করতে চাচ্ছে না। মুক্তিপণ দিয়ে নাবিকদের মুক্ত করার বিষয়ে অগ্রগতির কথা স্বীকার করেছে কেএসআরএম গ্রুপ। তবে মুক্তিপণের অঙ্ক কত, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিচ্ছে না তারা। এছাড়া এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বন্দি নাবিকদের বিকল্প আরও ২৩ নাবিককে প্রস্তুত করে রেখেছে জাহাজটির মালিকপক্ষ।
কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করার ব্যাপারে ভালো অগ্রগতি হয়েছে। কিছু বিষয় নিয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন। বীমা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় আমরা সে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আর কিছু বলা যাবে না। জিম্মি নাবিকদের মুক্তির দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলে আমরা সবাইকে জানিয়ে দেব।
মুক্তিপণের মাধ্যমেই নাবিকরা মুক্ত হচ্ছেন কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মুক্তিপণ ছাড়া সোমালীয় জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার নজির নেই। দয়া করে আর বেশি কিছু জানতে চাইবেন না। কৌশলগত কারণে সব প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনই দিতে পারব না।
নাবিকদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, আমরা যতটুকু জেনেছি, জিম্মি নাবিকদের মুক্ত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চাপের কারণে এবারে মুক্তিপণের টাকা পেতে জলদস্যুদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। কোন প্রক্রিয়ায় তারা মুক্তিপণের টাকা পাবে, সে বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার আগে তাই জিম্মিদের মুক্তির দিনক্ষণ ঘোষণা করছে না তারা। তবে ঈদের আগে নাবিকরা মুক্ত হচ্ছেন না– এটি অনেকটা নিশ্চিত।
অন্যদিকে মুক্তিপণ প্রদানের বিষয়টি তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়। জাহাজের মালিকপক্ষ প্রথমে যোগাযোগ করে বীমাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। পরে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বীমাকারী প্রতিষ্ঠান। মধ্যস্থতাকারীরা যোগাযোগ করে জলদস্যুদের প্রতিনিধির সঙ্গে। এই তিন পক্ষ পরস্পর আলোচনা করে মুক্তিপণের অঙ্ক ও প্রদান প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে। মুক্তিপণের টাকা ভাগ হয় পাঁচ ভাগে। জলদস্যুরা নিজেদের মধ্যে টাকা ভাগ করে তিনটি স্তরে। এই ভাগ যায় মধ্যস্থতাকারী ও মুক্তিপণের টাকা পরিবহন করে দেয়া গ্রুপের কাছেও।
১৪ বছর আগে জলদস্যু আক্রান্ত হওয়া এমভি জাহান মণি জাহাজের ক্ষেত্রেও এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মুক্তিপণ দেয়া হয়েছে এবং সেই টাকা ভাগ হয়েছে। সেবার মুক্তিপণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কেএসআরএম গ্রুপের সিইও মেহেরুল করিম। এবারও জাহাজ মালিকের হয়ে বীমা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তিনি।
জানা গেছে, মধ্যস্থতাকারী ও মুক্তিপণের টাকা পৌঁছে দেয়ার কাজে নিয়োজিত পরিবহন সংস্থা টাকার একটি অংশ পায়। মূল টাকা তিন ধাপে ভাগ করে নেয় জলদস্যুরা। প্রথমে যারা জাহাজে উঠে তাদের মূল টাকা থেকে একটি নির্ধারিত অংশ বোনাস হিসেবে দেওয়া হয়। ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ টাকা পায় প্রথম যারা জাহাজটি ছিনতাই করেছে সেই দল। বাকি টাকা ভাগ করে নেয় দ্বিতীয় ধাপে যারা জাহাজটি পাহারা দেয় তারা।
জাহাজের জ্বালানি ও খাবারসহ পরিচালনাগত খরচ আলাদাভাবে হিসাব করে জলদস্যুরা। এমভি জাহান মণি জাহাজের ক্ষেত্রে আমরা এমন ভাগবাটোয়ারা হওয়ার কথা জানতে পেরেছি। জানা গেছে, মুক্তিপণের টাকা দিয়ে সোমালীয় জলদস্যুরা পরিচালনা করে নিজস্ব স্টক এক্সচেঞ্জও। অর্থ বা অস্ত্র দিয়ে এই স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগ করা যায়। অভিযান সফল হলে পাওয়া যায় লভ্যাংশ। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বিনিয়োগকারী এই স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে এক মাসে ৭৫ হাজার ডলারও উপার্জন করেছে। এ জন্য জলদস্যু হতে আগ্রহী হচ্ছে সোমালিয়ার সাধারণ মানুষও।
উল্লেখ্য, গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাই করে জলদস্যুরা। জাহাজটি এখন সোমালিয়ার গদভজিরান উপকূলের কাছে নোঙর করা আছে। জাহাজটিতে জলদস্যুরা ওঠার পরপরই একটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি দূরপাল্লার টহল জাহাজ মোতায়েন করেছিল ভারতীয় নৌবাহিনী। বাংলাদেশি জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে নেওয়া পর্যন্ত সেটির কাছাকাছি এলাকায় অবস্থান নিয়ে অনুসরণ করেছিল ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ। এর মধ্যে আবার ভারতীয় নৌবাহিনীর সদস্যরা সোমালি জলদস্যুদের কবল থেকে মাল্টার পতাকাবাহী কার্গো এমভি রুয়েন উদ্ধার করে।
এর দুই দিনের মাথায় পান্টল্যান্ড পুলিশ জানায়, এমভি আবদুল্লাহকে দখল করে রাখা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিতে প্রস্তুত রয়েছে তারা। পান্টল্যান্ড পুলিশ জলদস্যুদের দুই সহযোগীকে মাদকসহ আটকও করে। এমন চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকায় মুক্তিপণের জন্য মালিকপক্ষের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করেছে জলদস্যুরা। এ ছাড়া চাপের কারণে সমাধানের পথেও এগোচ্ছে তারা।
এআর-৬/৪/২৪
Share your comment :