রাজধানীতে গরমের শরবতে ‘মাছের বরফ’
নিজস্ব প্রতিবেদক:
আবহাওয়া বিষয়ক ওয়েবসাইট ওয়েদার ডটকমের তথ্য জানিয়েছে শুক্রবার ১৯ এপ্রিল রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত অনুভূত হচ্ছে। টানা তীব্র এই গরমে হাঁপিয়ে উঠছে রাজধানীবাসী। একটু স্বস্তি পেতে তারা নানা উপায় খুঁজছে। এর মধ্যে কেউ কেউ ভিড় করছে বোতলজাত কোমল পানীয় ও জুসের (শরবত) দোকানে৷ কিন্তু সেই দোকানগুলোতে বিক্রি হওয়া পানীয় কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। বিশেষ করে জুসের সঙ্গে যে বরফ ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা মাছের বরফ বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর’বি) গণমাধ্যম ব্যবস্থাপক তারিফুল ইসলাম খান সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, হাসপাতালটিতে বর্তমানে সাড়ে চার শতাধিক রোগী ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি আছেন। চিকিৎসকদের মতে, ডায়রিয়া পানিবাহিত রোগ। বোতলজাত কোমল পানীয় বিভিন্ন মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে বাজারে আসে৷ ফলে এতে অন্যান্য রোগের ঝুঁকি থাকলেও ডায়রিয়ার জীবাণু থাকার প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে নগরে খোলা পরিবেশে বিক্রি হওয়া শরবতে পানিবাহিত রোগের জীবাণু পাওয়ার ঘটনা বেশ পুরনো।
রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া খোলা শরবত বা পানীয়তে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে, এটি সবারই জানা। এ ব্যাপারে দিন দিন সচেতনতা বাড়ছেও। ফলে নিুআয়ের মানুষ ও দিনমজুর শ্রেণির মানুষ ছাড়া রাস্তার পাশের খোলা পানীয় পান করেন খুব কমসংখ্যক নগরবাসী। কিন্তু নগরীতে চলা জুস বারগুলোর ব্যাপারে সচেতন নন বেশির ভাগ নগরবাসী। খরচ বেশি হলেও সুসজ্জিত ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশের জুস বার এখন ভরসা হয়ে উঠেছে রাজধানীবাসীর। এজন্য এসব বারে সবসময় ভিড় লেগেই থাকে। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব বারে জুস ঠান্ডা করতে যে বরফ ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে রয়েছে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হলের সবচেয়ে বড় জুসের দোকান সিঙ্গাপুর জুস বার। কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, দৈনিক হাজার গ্লাসের বেশি জুস বিক্রি করেন তারা। তবে স্থানীয়দের দাবি, বিক্রির পরিমাণ আরও অনেক বেশি।
টাউন হল বাজারের বিপরীতে উর্দুভাষী ক্যাম্প। সেখানে রয়েছে একটি বরফ কল। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বরফকল সংশ্লিষ্ট একজন ব্যক্তি জানান, অনেক জুসের দোকানেই তাদের তৈরি বরফ যায়। বিক্রেতা স্বীকারও করেন, তাদের তৈরি ‘বরফ খাওয়ার উপযোগী না’। এই বরফকল শ্রমিক বলেন, ‘আমরা বরফ বানাই মাছের জন্য। কে খাইলো সেইটা দেখার কাজ আমার না।’
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, টাউন হল ক্যাম্পের বরফ কল থেকে তৈরি মাছের বরফ যাচ্ছে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, তাজমহল রোড, লালমাটিয়াসহ আশপাশের এলাকার রেস্তোরাঁ ও জুস বারে৷ মাছের জন্য তৈরি বরফ দিয়ে নগরবাসীকে খাওয়ানো হচ্ছে দেশীয় ফলের জুস, লাচ্ছি, ফালুদা। এ ছাড়া রাজধানীর মিরপুর, গুলিস্তান, সায়দাবাদ, মহাখালী, গুলশান, বনানী, বিমান বন্দর বাস স্টপিজ এর সামনে, নিউমার্কেট শাহনেওয়াজ হলের সামনে, লালবাগ, পলাশী, হাজারীবাগসহ রাজধানীর আরও অনেক যায়গায় খোলা স্থানে এবং ছোটখাট দোকানে শরবত বিক্রি হচ্ছে। এসব দোকানের শরবতে কী ধরণের বরফ ব্যাবহার হচ্ছে তা সরাসরি দেখার বা জানার সুযোগ নেই।অনেকে মনে করেন এসব শরবত মানহীন বরফ দিয়ে বাননো হচ্ছে ।এসব শরবত পান করে অনেকেই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
হাজারীবাগ এলাকার বাসিন্দা লিজা আক্তার তার ছোট ছেলেকে রাস্তার শরবত কিনে খাওয়ালেন, তিনি প্রতিবেদকে জানান, বাচ্চা খেতে চাইলো, না দিয়ে কোন উপায় নেই, এসব শরবতের বরফ ভালো না সেটা আমরা জেনেও কিছু করার নাই। আমরা বড়রা এসব শরবত পান করি না কিন্তু বাচ্চারা মানতে চায় না। তবে এসব দোকানে ভোক্তা অধিকার মাঝে মাঝে তাদের তদারকি করতে পারে, কেননা আমাদের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের, আমরা শুধু সচেতন হতে পারবো কিন্ত এটা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।
গাবতলী-বাবুবাজার বেড়িবাঁধ সড়কের স্লুইস গেইট এলাকার বরফ কলের কর্মী তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এই কল থেকে চারটা বাজার চলে। আমরা শুধু মাছের জন্য বরফ বানাই। ক্যাটারিংয়েও যায়। তারা পাতিলের নিচে দেয়, খাবার ঠান্ডা করতে।’
জুসের দোকান বা শরবত বিক্রেতার কাছে এই বরফ যাচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বরফ তো যে কেউ কিনতে পারে। আমরা সবার কাছেই বিক্রি করি। কিন্তু আমাদের মালিকের বলা আছে, যেই আসুন, আমরা যেন বলে দিই এটা খাওয়ার বরফ না। আমরাও কাস্টমার দেখলেই বুঝি, কে বাজারের না। আমরা বলি, এই বরফ খাওয়ার জন্য না। আমরা ডাইরেক সাপ্লাই পানি দিয়া বানাই।’
বরফ কলটি ঘুরে দেখতে চাইলে তাতে আপত্তি করেননি এই শ্রমিক। বেড়িবাঁধ সড়ক লাগোয়া বরফ কলটি প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে নোংরা পরিবেশ৷ বরফ তৈরির জন্য ছাঁচে পানি জমা করে যে কাঠ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে, তা অত্যন্ত নোংরা। পুরো বরফকল রয়েছে মাছির দখলে। সঙ্গে বেড়িবাঁধ সড়ক থেকে উড়ে আসা ধূলো তো আছেই।
এআর-২০/০৪/২৪
Share your comment :