হঠাৎ কেন আলোচনায় মেজর ডালিম?

হঠাৎ কেন আলোচনায় মেজর ডালিম?

বাংলাকন্ঠ রিপাের্ট:
শরিফুল হক ডালিম। যিনি মেজর ডালিম নামেই বেশি পরিচিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সাবেক কর্মকর্তা। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

রোববার দিবাগত রাতে প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের ইউটিউব চ্যানেলে লাইভ টকশোতে কথা বলেছেন দীর্ঘদিন আড়ালে থাকা মেজর শরিফুল হক ডালিম। ‘বিশেষ লাইভে যুক্ত আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর ডালিম (বীর বিক্রম)’ শিরোনামে লাইভে যুক্ত হন সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা।

টকশোতে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের নেপথ্যের ইতিহাস তুলে ধরেন বিদেশে নির্বাসিত আলোচিত এই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা। তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-

শুরুতে মেজর ডালিম বলেন, ‘দেশবাসীকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছাত্র-জনতাকে, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে যারা আংশিক বিজয় অর্জন করেছেন তাদের আমি অভিনন্দন জানাই। সঙ্গে লাল ছালাম। বিপ্লব সমাজ বা যেকোনো রাষ্ট্রে একটি চলমান প্রক্রিয়া। সেই অর্থে তাদের বিজয় এখনও পুরোপুরিভাবে অর্জিত হয়নি। তার জন্য আরও সময় প্রয়োজন’।

২৪’এর গণঅভ্যুত্থানের নেপথ্যের নায়ক ছাত্র-জনতাকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরোপুরি অর্জন করার পর তাদের এমন একটি অবস্থানে থাকতে হবে, যেখান থেকে তারা নীতি নির্ধারণ করতে পারবে। তাদের ইচ্ছা, চাহিদা ও প্রত্যাশার সঙ্গে জনগণের চাহিদার মিল রয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব কিন্তু তাদের।’

মেজর ডালিম বলেন, ‘সম্প্রসারণবাদী-হিন্দুত্ববাদী ভারত যার কবজায় আমরা প্রায় চলে গিয়েছি। সেই অবস্থান থেকে ৭১’এর মতো আরেকটা স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। তা না হলে বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামের আগে শেখ মুজিবের চরিত্র ছিল এক। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংগ্রামে অবদান রেখেছেন। পাকিস্তান আর্মি যখন ২৫ ও ২৬ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালায়। যাতে লক্ষ লক্ষ, হাজার হাজার শিশু-নারী-পুরুষ প্রাণ হারালো কোনো কারণ ছাড়া। তারপর সেই অবস্থায় তথাকথিত নেতাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। তারা তখন তাদের নিজেদের জীবন বাঁচিয়ে যার যার মতো জায়গায় চলে গেলেন। মুজিব স্বয়ং পাকিস্তান আর্মির কাছে ধরা দিলেন। তাদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে পরিবারের ভরণপোষণ পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়ে পালিয়ে গেলেন।’

ডালিম বলেন, ‘তখন দিকহারা-দিশেহারা মানুষ বুঝতে পারছিলো না তারা কী করবে। কোথায় যাবে, কীভাবে প্রাণ বাঁচাবে। সেই সময়ে চট্টগ্রাম থেকে ভেসে আসলো মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ডাক। আমি তখন পাকিস্তান আর্মিতে। সেই ডাকে দেশের মানুষ একটা আলো রশ্মি দেখলো। আমাদেরকে এইভাবে মরণের হাত থেকে বাঁচার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। এরপর মুক্তিযুদ্ধের ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তুললো। আমরা আর বসে থাকলাম না। যাদের সাহস ছিল, দেশ প্রেম ছিল তারা সেই সংগ্রামে যোগ দিল।’

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কারণ জানতে চাইলে বিস্তারিত তুলে ধরেন মেজর ডালিম। তিনি বলেন, ‘খুবই স্পর্শকাতর প্রশ্ন। নিজের বাদ্য নিজে বাজানো যায় না। প্রথম কথা, ১৫ই আগস্ট কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। এটার সূত্রপাত হয় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায়। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা কাদের ইন্টারেস্টে হচ্ছে? এটা কি আমাদের ইন্টারেস্টের জন্য হচ্ছে যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করবো? নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে।’

এই বীর বিক্রম বলেন, ‘যখন সাত দফাতে চুক্তি করে নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিনকে পারমিশন দেয়া হলো একটা প্রভিশনাল গভমেন্ট গঠন করার। সাতটা ক্লজ পড়ে সাইন করার পর নজরুল ইসলাম ফিট হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। এটা যে একটা দাসখত আমরা ক্রমান্বয়ে ভারতের একটা করদরাজ্য-অঙ্গরাজ্যে পরিণত হবো।’

মেজর ডালিম বলেন, ‘শেখ মুজিবকে যখন ছাড়া হলো, তখন তো তিনি কিছুই জানতেন না। দেশ স্বাধীন হয়েছে, নাকি মুক্তিফৌজ বলে কিছু ছিল। হাজার হাজার মানুষ দেশ ছেড়েছে, প্রাণ হারিয়েছে সেসব কিছুই জানতেন না। তাকে যখন ছেড়ে দেয়া হলো ইন্দিরাগান্ধীকে ফোন করে মুজিব বললেন-আমি দেশে ফিরে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে আপনার সঙ্গে দেখা করে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। তখন গান্ধী বললেন, আপনি না ফোন করলে আমিই আপনাকে ফোন করতাম। আপনি নয়াদিল্লি হয়ে ঢাকায় যাবেন। মুজিব সেটাই করলেন, লন্ডন হয়ে নয়াদিল্লি গেলেন।’

দেশে ফিরলেন মুজিব। তার ক্ষমতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মুজিবকে দিয়ে রক্ষীবাহিনী তৈরি করলো ভারত। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করে নামে মাত্র সেনাবাহিনী রাখবে। মুজিব কায়েম করলেন একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক বাকশাল। তিনি চিন্তা করলেন নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দেবেন। এই বাকশালের সদস্য সবাই। সেই বাকশাল করার পর মুজিবের শক্তি বেড়ে গেলো। তার নিষ্ঠুরতা এমন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেলো যে মানুষ একদিন মুজিবের জন্য দোয়া করেছিল-এই মুজিব আমাদের চোখের মনি। আমাদের বাঁচাবে সেই মুজিবের জন্য মানুষ আল্লাহর কাছে দোয়া চাচ্ছিলো আমাদের মুজিবের হাত থেকে বাঁচাও, আমরা মরে যাচ্ছি।’

টকশোতে মেজর ডালিম বলেন, ‘মুজিব তো মারা যায়নি, মুজিব একটি সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। সেনা অভ্যুত্থান তো আর খালি হাতে মার্বেল খেলা না। ওখানে দুই পক্ষ থেকেই গোলাগুলি হয় এবং হতাহত হয় দুইপক্ষেই। যেমন মুজিবের পক্ষের কিছু লোক মারা গেলো, সেভাবে সেনাঅভ্যুত্থানকারী বিপ্লবীদের পক্ষ থেকেও কিছু লোক প্রাণ হারায়। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু বিপ্লবীরা বিজয়ী হয়ে গেল, তারা ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিলো।’

তিনি বলেন, ‘মুজিবের মৃত্যু ও বাকশাল পতনের খবর জানার পর শহর, বন্দর ও গ্রামের লাখ লাখ মানুষ আনন্দ মিছিল বের করলো। যে সমস্ত রাজনৈতিক নেতা বা দলগুলো আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল তারাও জনসমর্থন নিয়ে রাস্তায় চলে আসে। এভাবেই জনস্বীকৃতি পেয়েছিল ১৫ই আগস্টের বৈপ্লবিক সামরিক অভ্যুত্থান।’

Share your comment :