কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন:বাণিজ্য বেসরকারি ঋণে প্রবৃদ্ধি ৪০ মাসে সর্বনিম্ন
বাংলাকণ্ঠ রিপোর্ট:
মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর প্রভাবে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ধারাবাহিকভাবে কমছে। সবশেষ নীতি সুদহার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশ। বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর এক মাসের ব্যবধানে সুদহার দুই দফা বাড়ানোর ঘটনাও ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে ধস নেমেছে।
জানা গেছে, দেশের অর্থনীতির প্রাণ বেসরকারি খাত। কারণ এখান থেকেই প্রতি বছর তৈরি হয় হাজার হাজার কর্মসংস্থান। জাতীয় উৎপাদনও নির্ভর করে এ খাতের ওপর। কিন্তু ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি। সবশেষ গত অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশে, যা গত ৪০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২১ সালের মে মাসে সর্বনিম্ন ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই বছর ধরে শেখ হাসিনা সরকারের ভুলনীতির কারণে অস্থির ছিল ডলার বাজার। কারণ এই দুই বছরের মধ্যে ৮৫ থেকে ১২০ টাকায় পৌঁছেছে ডলারের দাম। তাই তখন থেকেই ধারাবাহিকভাবে ডলারের রেট বাড়ছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা আমদানি করার ক্ষেত্রে নানা হিসাব করে আসছেন। যার কারণে তখন থেকেই বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে।
এ ছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীলতা ও ব্যাংকঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় কমছে বেসরকারি খাতের ঋণ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনও স্থিতিশীল হয়নি। এমন অনিশ্চিত পরিবেশে কেউ নতুন বিনিয়োগ করছেন না। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে। এতে ব্যাংকঋণের সুদহার অনেক বেড়ে গেছে। তাই ব্যবসায়ীরা উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগে পিছু হাঁটছে। ফলে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিও কমেছে।
তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবরে ব্যাংক খাতের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৫৬ হাজার ২০২ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৫ লাখ ২৯ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। যদিও ২০২৩ সালের অক্টোবরে তার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। সেই হিসেবে এক মাসে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৯০ পয়েন্ট।
সাবেক সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ নির্ধারণ করে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সরকার পরিবর্তনের পর সেই মুদ্রানীতি আর পরিবর্তন করা হয়নি। তবে কয়েকবার নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। এ রকম পরিবেশে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করবেন না, যে কারণে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে। আন্দোলন ছাড়াও সুদহার বৃদ্ধি, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়া এবং অনেক জায়গায় ঠিকমতো বিদ্যুৎ না পাওয়ার বিষয়ও বিনিয়োগে প্রভাব ফেলছে বলে তিনি মনে করেন। তার মতে, বেশ কয়েক মাস ধরেই ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে সময় নিচ্ছেন। তারা পরিস্থিতি বুঝে সামনে বিনিয়োগ করবেন। তা ছাড়া আমদানি কমে যাওয়ার একটা প্রভাব পড়ছে। বার রপ্তানি আশানুরূপ না বাড়ারও প্রভ রয়েছে।
বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ২০২২ সালের প্রথম দিকে ১০ শতাংশের ওপর ছিল। ওই বছর তা ১৪ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। এর পর বিভিন্ন কারণে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়তে থাকলে তা কমিয়ে আনতে নীতি সুদহার রেপো বাড়ানো হয়। মুদ্রানীতিতে আরও সংকোচনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এতে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে আবার কমতে শুরু করে ঋণ প্রবৃদ্ধি। এখন তা কমতে কমতে ৮ শতাংশের ঘরে। এর পরও মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছে না।
নভেম্বর মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, যা প্রায় ১৪ শতাংশে উঠে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে, গত মাসে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত অক্টোবরে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে জানুয়ারিতে ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ১২ দশমিক ১৪, মার্চে ১২ দশমিক শূন্য ৪, এপ্রিলে ১১ দশমিক ২৮, মে মাসে ১১ দশমিক শূন্য ১, জুনে ১০ দশমিক ৫৭, জুলাইয়ে ৯ দশমিক ৮২, আগস্টে ৯ দশমিক ৭৫, সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৬৯ ও অক্টোবরে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।
এএ/
Share your comment :