এখনো ফ্যাসিবাদীদের দখলে আটাব

বিশেষ প্রতিনিধি :
স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের আট মাসেও কোনো পরিবর্তন আসেনি অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)-এর শীর্ষ নেতৃত্বে। সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে কয়েক কোটি টাকা আত্ত্বসাৎ ও লুটপাট এবং বিদেশে পাচারের সুর্নিদিষ্ট অভিযোগ এনে কমিটি বাদ দিয়ে সেখানে প্রশাসক নিয়োগের দাবি জানালেও রহস্যজনক কারণে এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে চিহিৃত দূর্নীতিবাজ নেতাদের দ্রুত গ্রেফতারের পাশাপাশি আটাবকে কলঙ্কমুক্তকরণের পরিবর্তে এখনো তারা বহাল তবিয়তে থাকায় মন্ত্রণালয়ের রহস্যজনক আচরণে ক্ষোভ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

আটাব সূত্র জানায়, পতিত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আটাবের বর্তমান সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ ও মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহ-এর নেতৃত্বাধীন বিতর্কিত কমিটি বাতিল করে সেখানে দ্রুত প্রশাসক নিয়োগ করে পরবর্তী কার্যক্রম চালাতে তিন দফা দাবিতে গত মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন আটাব সংস্কার পরিষদ। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও স্বৈরাচার হাসিনার দোসর আটাব কমিটি বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ করে আটাবকে কলঙ্কমুক্তকরণের পাশাপাশি বিতর্কিত নেতাদের দ্রুত গ্রেফতারের জোর দাবি জানান তারা।

কিন্তু অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় আটাবের বর্তমান সভাপতি ও মহাসচিব দিব্যি পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে আটাব সংস্কার পরিষদের নেতারা গত ১৮ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগের মহাপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
একই দিন তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের নিকট স্বৈরাচার হাসিনার দোসর বর্তমান আটাব কমিটি বাতিল করে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে আটাবকে কলঙ্কমুক্তকরণের পাশাপাশি বিতর্কিত নেতাদের দ্রুত গ্রেফতারের জোর দাবিও জানান। সেই সঙ্গে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগী আটাব কমিটিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্সের সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করার দাবি জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব (বিমান ও সিএ) ও টাস্কফোর্সের সভাপতির কাছে লিখিত দেন আটাব সংস্কার পরিষদ। কিন্তু বিগত এক মাসেও এ নিয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে আটাবের সাধারণ সদস্যদের অভিযোগ।

মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, আটাবের বর্তমান সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ ও মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহসহ প্রায় সবাই কট্টর আওয়ামী লীগার। তারা ২০২০ সালে আটাব অনলাইন নামক একটি (ওটিএ-অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি) প্রতিষ্ঠা করে যা বাণিজ্য সংঘ বিধি ও আটাব সদস্যদের স্বার্থের পরিপন্থি। এরইমধ্যে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আটাব অনলাইনের নামে অবৈধভাবে আব্দুস সালাম আরেফের মালিকানাধীন ট্রাভেল এজেন্সি এয়ার স্পিড ৭৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকা এবং আফসিয়া জান্নাত সালেহ-এর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সায়মন ওভারসিজের নামে ৯৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকার চেক ইস্যু করে আত্মসাৎ করেন। সম্প্রতি সদস্যদের আইনি প্রক্রিয়ার কারণে আটাব অনলাইনকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলেও তারা শেয়ার হোল্ডারদেরকে কোনো টাকা ফেরত দেয়নি।

এছাড়াও আটাবের বর্তমান মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহ’র বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে আটাব সদস্যদের নিয়ে জাপানে একটি ট্যুরের নামে ৫৫ লাখ ৭৭ হাজার ৮৪৫ টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচারের অভিযোগও রয়েছে। আটাব অনলাইনের নামে কয়েকজন সদস্যদের নিয়ে জাপানে একটি ট্রিপের নামে জাপানী একটি ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে উক্ত টাকা পাঠানোর নাম করে সায়মন ওভারসীজের নামে চেক (সি৭১৩৪৮৩৬/ ২৭/১/২৪, এমটিবি হিসাব নং ১৪১ কাকরাইল শাখায়) জমা দেন। যদিও সায়মন ওভারসীজ এ টাকা পাঠানোর কোনো এখতিয়ার রাখে না এবং সে টাকা আর ফেরত দেওয়া হয়নি। এভাবে তিনি বিদেশে অর্থপাচার করেছেন বলেও অভিযোগ সদস্যদের।

এদিকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ পরিচয়দানকারী আটাব সভাপতি আবদুস সালাম আরেফের বিরুদ্ধে কোনো ট্রাভেল এজেন্সি এমনকি কোনো এয়ারলাইন্স বিগত ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের আগে কোনো কথা বলার সাহস পেত না। এয়ারলাইন্সগুলো তার অনৈতিক টিকিট গ্রুপ ব্লকিংয়ের কাজে সহযোগিতা করতে বাধ্য হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, গ্রুপ টিকিট ব্যবসায় মাফিয়া খ্যাত এয়ার স্পিড (প্রা.) লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বর্তমান আটাব সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ বিভিন্ন এয়ার লাইন্সের টিকিট গ্রুপ বুকিংয়ের মাধ্যমে ব্লক করে এয়ার স্পিড নামক একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে প্রচার করেন এবং চড়া দামে বিক্রি করে থাকেন।
২০২৩-২৪ সালে মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের (লেবার) টিকিটের গ্রুপ ব্লকিং এবং ২০২৫ সালে সউদীগামী (লেবার) টিকিট ব্লকিংয়ের মাধ্যমে মূল্য বৃদ্ধি করে বিক্রি করেছেন। এখন আওয়ামীপন্থি আটাব সভাপতি নিজের অপকর্ম ঢাকতে এবং বর্তমান সরকারকে বিতর্কিত করার জন্য ট্রাভেল এজেন্সি এবং এয়ার লাইন্সের মধ্যে বিরোধ তৈরি করে এয়ার টিকিট ব্যবসায় নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে এদেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ।

মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, আটাব সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা বাহাউদ্দিন নাসিমের আত্মীয় পরিচয়ে এবং প্রশাসনের সহায়তায় ২০১১ সাল থেকে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন দিয়ে দুবার মহাসচিব এবং বর্তমান সভাপতি হিসেব আটাব দখল করে আছেন। ভূয়া ভোটার তালিকা, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট এবং প্রতিপক্ষকে কেন্দ্র থেকে বের দিয়ে স্বঘোষিত ফলাফল নিয়ে বারবার নির্বাচিত হয়ে টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করেছেন। জুলাই-আগস্ট ২০২৪ স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে গণ-আন্দোলন হয়েছিল তা প্রতিহত করার জন্য শেখ হাসিনার বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের নিয়ে ৩ আগস্ট ২০২৪ যে ষড়যন্ত্রমূলক সভাটি করেছিলেন সেখানে বর্তমান আটাব সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া আটাব মহাসচিব মিসেস আফসিয়া জান্নাত আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা মরহুম মুহায়মিন সালেহ-এর কন্যা। আফসিয়া জান্নাত সালেহ ও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ নেত্রী পরিচয়ে আটাব নেতৃত্বে আসেন এবং নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে একাধিকবার নির্বাচিত হয়ে কমিটির সবাইকে নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করেন।

আটাব সংস্কার পরিষদের আহ্বায়ক মো. গোফরান চৌধুরী বলেন, আটাব সভাপতি ও মহাসচিব তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে আটাব অনলাইন বিলুপ্ত ঘোষণা করে নামে বেনামে চেকের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, আটাবের বর্তমান সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ ও মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহ্ আওয়ামী লীগপন্থি এবং তারা বিভিন্নভাবে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন’ বলে আমরা তাদের বিচার চাই।

আটাব সংস্কার পরিষদের সদস্য সচিব মো. আমির হোসেন আরিফ বলেন, এর আগেও আটাব সভাপতি সালাম আরেফ বিভিন্ন সময়ে টিকিটের গ্রুপ বুকিংয়ের মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। এসব অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান কমিটিকে বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগের দাবি জানাই।

জানতে চাইলে আটাব মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহ বলেন, যারা টিকিট সিন্ডিকেট করে এক লাখ টাকার টিকিট দুই লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারছে না সেই চক্রই আটাব সংস্কার পরিষদের নামে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে আটাবের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। ফ্যাসিস্ট বিগত সরকারের দোসর বলে আমাদের যে তকমা দেয়া হচ্ছে তা সঠিক নয়। আমরা সংগঠন করি সদস্যদের স্বার্থে, যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তাদের সাথে আটাব নেতাদের মিশতে হয়, যেতে হয়Ñ তাতে দোষের কিছু নেই। এছাড়া আটাব অনলাইনের লাখ লাখ টাকা সভাপতি ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে আত্মসাতের অভিযোগও মিথ্যা বলে আটাব মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহ দাবি করেন।

এর আগে ২০২২ সালে আটাব অনলাইন লিমিটেড গঠনের নামে সাবেক সভাপতি এস এন মনজুর মোর্শেদ ও সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম আরেফের বিরুদ্ধে তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনেছে এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)। তখন এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বরাবরে অভিযোগপত্র দাখিল করে সংগঠনটির তৎকালীন কমিটি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠিতে তখন আটাব জানায়, ২০১৭-১৯ এ আটাবের সভাপতি ছিলেন এসএন মনজুর মোর্শেদ মাহবুব ও মহাসচিব ছিলেন আবদুস সালাম আরেফ। তারা আটাবের নাম ব্যবহার করে স্বার্থ পরিপন্থী আটাব অনলাইন লিমিটেড কোম্পানি গঠনের জন্য ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ জরুরি সাধারণ সভা ডেকে আটাব অনলাইন লিমিটেড গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।