শিকলে বেঁধে তরুণী ধর্ষণ :ভাড়া করা ফ্ল্যাটটি একজন আইন কর্মকর্তার
নিজস্ব প্রতিবেদক:
শিকলে বেঁধে ২৫ দিন ধরে তরুণীকে ধর্ষণের চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি যে ফ্ল্যাটে ঘটেছে সেটির মালিক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল রায়হান কবির।
ফ্ল্যাটটি মাস চারেক আগে তিনি ভাড়া দিয়েছিলেন সালমা ওরফে ঝুমুরের কাছে। তবে কোনো চুক্তিপত্র করেননি ভাড়াটিয়া সালমার সঙ্গে। ধর্ষণ-কাণ্ডের মূল হোতা সালমা ছদ্মনামে (ফাইজা আক্তার) থাকতেন ফ্ল্যাটটিতে।
এদিকে ঘটনার পর সালমার মোবাইল ফোনটি পুলিশ জব্দ করতে পারেনি। সালমার দাবি ফোনটি হারিয়ে গেছে। এছাড়া ধর্ষণ-কাণ্ডে নেপথ্যে থাকা কথিত ব্যারিস্টার মাসুদের বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য না পাওয়ার দাবি করেছে পুলিশ। ধর্ষণের ঘটনায় তরুণীর করা মামলায় গ্রেফতার চার আসামির ৩ দিনের রিমান্ড বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। তাদের ফের ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের শেষ প্রান্তের ১৬ নম্বর সড়কে ৩৯/৪১ নম্বর প্লটে ১১ তলা ভবন। এর পঞ্চমতলার দুই বেডরুমের একটি ফ্ল্যাটে ঘটে ওই লোমহর্ষক ধর্ষণ-কাণ্ড। বৃহস্পতিবার দুপুরে ভবনের ফটকের সামনে গিয়ে দেখা যায় নিরাপত্তা প্রহরীর সতর্কাবস্থান।
ভবনটির বাসিন্দারা জানান, যে ফ্ল্যাটে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সেখানে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে মাঝেমধ্যেই লোক আসত। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে এমন ঘটনায় তারা স্তম্ভিত বলে জানান।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইলে আব্দুল হক নামের ভবনের এক নিরাপত্তাপ্রহরী জানান, বিল্ডিং ব্যবস্থাপনা কমিটি সাংবাদিক প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। কমিটির সভাপতি মাহাবুব ও সাধারণ সম্পাদক হাবিব বলে তিনি জানান। এ সময় ফটকের সামনে দাঁড়িয়েই ঘটনার রাতের বর্ণনা দেন তিনি। স্থানীয় শতাধিক জনতা ও পুলিশ ভুক্তভোগী তরুণীকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় বলে জানান।
ভাড়াটিয়া সালমার বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল হক বলেন, ‘আমাদের কাছে ফাইজা আক্তার বলে পারিচয় দিতেন তিনি। ঘটনার পর জানতে পেরেছি তার নাম সালমা। ৪ থেকে ৫ বছরের এক ছেলে ও এক তরুণীকে নিয়ে ফ্ল্যাটটিতে থাকতেন সালমা। মাঝেমধ্যেই তারা বাইরে বের হতেন।’
তিনি আরও বলেন, সালমাদের ফ্ল্যাটে যারা আসতেন তাদের কখনো খালাতো, আবার কখনো মামাতো ভাই পরিচয় দিয়ে ভবনের নিচ থেকে নিয়ে যেতেন সালমা নিজেই। ফলে তাদের নাম-ঠিকানা লিখতেন না তারা। এভাবে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন যুবক বাসাটিতে আসত বলে জানান তিনি। ঘটনার ২ দিন পর হিমেল নামের এক যুবক ফ্ল্যাটটিতে যেতে চাইলে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেন তারা।
ভবনটির ৭ তলার বাসিন্দা মাহিয়ান আহম্মেদ রুমন জানান, নভেম্বর থেকে তিনি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন। সালমার সঙ্গে প্রতিবেশী হিসাবে ২ দিন কথা হয়েছে তার। সালমার স্বামী পরিচয় দেওয়া একজনের সঙ্গে দেখা হয় একবার। সালমা জানান, তার স্বামী গার্মেন্টস সেক্টরে ব্যবসা করেন। সে কারণে ইন্ডিয়াতে বেশি থাকা লাগে তার। অবশ্য পুলিশ বলছে সালমা ডিভোর্সি।
ঘটনার রাতের বিষয়ে তিনি বলেন, ইফতারের পর দুধ কিনতে বাইরে বের হই। যাওয়ার সময় সব স্বাভাবিক দেখলেও ফেরার সময় দেখি বাসার সামনে ৬০ থেকে ৭০ জন মানুষ জড়ো হয়েছেন। বাসার ভেতরে ঢুকে দেখি আরও ৫০-৬০ জন লোক সিঁড়িতে। এ সময় সালমা বাসায় প্রবেশ করেন। তখন পুলিশ তাকে ধরে।
সালমার মোবাইল ফোনের বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ যখন সালমার বাসার দরজার সামনে তখন সিকিউরিটি গার্ড, ফ্ল্যাট মালিক মাহবুব ও আসাদুজ্জামান আঙ্কেল ছিলেন। ওই সময় সালমার হাতেই তার মোবাইল ফোন দেখেছি আমি। মোবাইল হাতে নিয়েই উনি দরজার তালা খোলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ফারুকুল ইসলাম বলেন, ঘটনার সময় অন্য একজন এসআই ছিলেন। আমিও শুনেছি অনেকেই দেখেছেন সালমার হাতে মোবাইল ফোন ছিল। কিন্তু পরে সালমা দাবি করেন ফোনটি হারিয়ে গেছে।
ভবনটির নিচে কথা হয় ফ্ল্যাটের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মাহাবুবের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটের মালিক। মাস শেষে নিরাপত্তা প্রহরীদের বেতন সবার কাছ থেকে তুলে দিই। যে ফ্ল্যাটে ঘটনা ঘটেছে সেটির মালিক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ববি ওরফে রায়হান কবির। ৩-৪ মাস আগে সালমাকে ভাড়া দিয়েছেন তিনি। তবে কোনো চুক্তিপত্র করেননি। সালমা বলেছেন, তার স্বামী ইন্ডিয়া থেকে এলে চুক্তিপত্র তার নামে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফ্ল্যাট মালিক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল রায়হান কবির জানান, ওই ভবনে পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট তার। ফ্ল্যাটটি কে ভাড়া নিয়েছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব ইনফরমেশন পুলিশকে দিয়েছি।’ ফ্ল্যাটটি ভাড়া দেওয়ার সময় কেন চুক্তিনামা করেননি জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব না দিয়ে বলেন, ‘আমরা সব তথ্য পুলিশকে দিয়েছি। এর বাইরে কিছু বলতে চাচ্ছি না।’
১ মার্চ রাতে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের একটি ফ্ল্যাট থেকে শিকলবন্দি অবস্থায় ভুক্তভোগী এক তরুণীকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে চারজনের নাম উল্লেখ করে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন ওই তরুণী। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, তরুণীকে পৈশাচিকভাবে ২৫ দিন ধরে ধর্ষণই নয়, সংঘবদ্ধভাবে শারীরিক নির্যাতনও চালানো হয়।
এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতাররা হলেন-সালমা ওরফে ঝুমুর (২৮), আবিদ তাসিন সান (২০), সালমান আহমেদ জয় ওরফে রকি (২৭) ও আতিক রহমান হিমেল (২৭)। ভুক্তভোগী তরুণী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ-ক্রাইসিস সেন্টার থেকে বৃহস্পতিবার গ্রামের বাড়িতে গেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
রিমান্ডে আসামিদের দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী কথিত ব্যারিস্টার মাসুদের পরিকল্পনায় সবকিছু করেছে তারা। এই ব্যারিস্টার পরিবার নিয়ে লন্ডনে থাকেন। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশে এসে সময় কাটান ওই তরুণীর সঙ্গে। প্রায় ৭ বছর ধরে ওই তরুণীর ভরণ-পোষণ দিচ্ছেন কথিত ব্যারিস্টার। মামলার এজাহারেও ভুক্তভোগী তরুণী উল্লেখ করেন, তার দুলাভাইয়ের মাধ্যমে পরিচয় হয় ব্যরিস্টার মাসুদের সঙ্গে।
তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালে তার মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে বের হয়ে নিখোঁজ হন তার শালী ভুক্তভোগী তরুণী। এর কিছুদিন পর তার বাবাকে ফোন করে জানায় সে বিয়ে করে সংসার করছে। তার স্বামী বিদেশ থাকে। ভুক্তভোগী তরুণী মাঝেমধ্যেই কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে যেত বলে জানান তিনি। ওই তরুণীর সঙ্গে তাদের তেমন যোগাযোগ ছিল না বলে দাবি করেন তিনি।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানিয়েছে ব্যারিস্টার মাসুদ ওই তরুণীকে দেখভালের জন্য সালমাকে নিয়োগ করেন। গত ৩ মাসে দেড় লাখ টাকা পাঠান ওই তরুণীকে। সেখান থেকে ওই তরুণী নিয়মিত তার গ্রামের বাড়িতে বাবার কাছে টাকা পাঠাতেন।
এদিকে মাসুদের অনুপস্থিতিতে ওই তরুণী সানের সঙ্গে প্রেম ও দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। পরে সানকে বিয়ে করতে বলে ওই তরুণী। সান বিয়েতে রাজি না হলে মামলার হুমকি দেয়। এরপরই সান ও তার দুই বন্ধু রকি ও হিমেল মিলে সালমার কাছে বিচার দেয়। সালমা সার্বিক বিষয় ব্যারিস্টার মাসুদকে জানালে মাসুদের নির্দেশে ধর্ষণ ও ভিডিও ধারণের ঘটনা ঘটে।
এআর-০৫/০৪/২৪
Share your comment :