ভর্তি পরীক্ষায় বহুনির্বাচনী পদ্ধতি বাদ দেওয়ার সুপারিশ শিক্ষক নেটওয়ার্কের
বাংলাকণ্ঠ রিপোর্ট:
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বহু-নির্বাচনীনির্ভর পদ্ধতি বাদ দিয়ে বুদ্ধিমত্তা-দক্ষতাভিত্তিক (অ্যাপ্টিচ্যুড টেস্ট) ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। একই সাথে প্রথম বর্ষ থেকে সিট বরাদ্দ, পূর্ণকালীন পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু এবং শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ থেকে সরে আসাসহ একাধিক প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি।
সোমবার (১৯ আগস্ট) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে শিক্ষক নেটওয়ার্ক আয়োজিত ‘কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় লিখিত বক্তব্যে এসব সুপারিশ করা হয়েছে।
দীর্ঘ সুপারিশপত্রে পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, প্রশাসন, সিলেবাস, গবেষণা, নীতিমালাসহ নানা বিষয়ে সুপারিশ উল্লেখ করা হয়।
সুপারিশের মধ্যে রয়েছে: বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্তরে আধিপত্যশীল রাজনীতি বন্ধ করা। প্রথম বর্ষে সবাইকে হলে সিট দেওয়া এবং তারপর ধীরে ধীরে উপরের দিকে মেধা ও চাহিদার ভিত্তিতে সিট বণ্টন হতে পারে। স্নাতকের সব ক্লাস ৪০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে সীমিত রাখা। যেসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ার আগ্রহ কম এমন বিভাগগুলোতে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী ভর্তি না করিয়ে কেবল স্নাতকোত্তর পর্যায়ের স্ট্রিম হিসাবে চালু রাখা যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়কে দ্বিভাষিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গড়ে তোলা যেখানে ছাত্রছাত্রীরা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় একাডেমিক কার্যক্রম সম্পন্ন করবে। শিক্ষার্থীদের কুশলী করে গড়ে তোলার জন্য অন্তত তিনটি ভাষা শেখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা এবং তথ্যপ্রযুক্তি দক্ষতার জন্য আলাদা ইনস্টিটিউট খোলা এবং সব বিভাগের আবশ্যিক ও আধা-আবশ্যিক কোর্স হিসাবে এতে অন্তর্ভুক্ত করা।
ঢালাওভাবে স্নাতকোত্তরের সুযোগ না রেখে নির্বাচিত শিক্ষার্থীদেরই সুযোগ দেওয়া; এতে গবেষণানির্ভর করে বিশ্বের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঢেলে সাজাতে হবে; একাধিক মাস্টার্স করার সুযোগ চাহিদা সাপেক্ষে তৈরি করা।
কেবল মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগ থেকে সরে এসে নিয়োগসংক্রান্ত পরীক্ষামূলক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি ঠিক করতে হবে এবং বাইরের দেশ থেকে ভিজিটিং প্রফেসর নিয়োগ করার দিকে যেতে হবে।
বিভাগকেন্দ্রিক শিক্ষক-সিন্ডিকেটের অবসান ঘটানো; যা শিক্ষার্থীদের ফলাফল নিয়ন্ত্রণ ও অনৈতিক প্রভাব বিস্তারে ভূমিকা রাখে।
উচ্চতর গবেষণায় একটা সম্পূর্ণ পূর্ণকালীন পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করা।
প্রাথমিক পরিকল্পনাটা হতে পারে এরকম: প্রতি বছর অনুষদের সক্ষমতা বিবেচনায় পিএইচডিতে ভর্তি (সর্বোচ্চ ১০০জন); তিন বছরের মধ্যেই প্রথম ব্যাচ ডিগ্রি শেষ করবে। ভর্তিকৃতদের সপরিবার আবাসিক সুবিধা দেওয়া এবং প্রথম শ্রেণি বেতন সমপরিমাণ বৃত্তি বরাদ্দ করা। দেশের এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশে কর্মরতদের দুটি দল সুপারভাইজ করবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিদেশে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির গ্রহণের বিদ্যমান সরকারি তহবিল বাতিল করে সেই তহবিল দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসম্পন্ন স্নাতকোত্তর গবেষণার জন্য ব্যয় করতে হবে।
এ ছাড়া বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ও উন্নত আন্তর্জাতিক জার্নালের অ্যাক্সেস ও প্রকাশনার জন্য শিক্ষকদের প্রণোদনা দেওয়া এবং শিক্ষকদের বৈশ্বিক গবেষণা তহবিল আনার সাফল্যের জন্য প্রণোদনা, মূল্যায়ন ও প্রশাসনিক সহযোগিতা দেওয়া ইত্যাদি সুপারিশ করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক প্রস্তাবনা প্রদানের শুরুতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত নয় এমন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভাগে ভাগ করেছেন। প্রাথমিকভাবে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করে পর্যায়ক্রমে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এটি করা হলে সামগ্রিক উচ্চতর গবেষণাকে নতুন যুগে প্রবেশ করাতে পারবে বলে নেটওয়ার্ক আশাবাদী।
এ ছাড়া দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কয়েকটি সংকট চিহ্নিত করেছে শিক্ষক নেটওয়ার্ক। এগুলো হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজের স্বার্থে ব্যবহারে সরকারের কর্তৃত্ব, ইউজিসির কৌশলপত্র যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়ানোর চাপ দেওয়া হয়েছে এবং সরকারি বরাদ্দ কমানোয় গুরুত্ব দেয়ায় মেধাবীদের উচ্চশিক্ষা কঠিন হয়ে পড়ছে, স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার, শিক্ষায় বরাদ্দ ও গবেষণা, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও বহুনির্বাচনীভিত্তিক ভর্তি পদ্ধতি।
সভায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, আমাদের কাঠামোর মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করতে হবে যেন ফ্যাসিজমের প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। যেখানে পাকিস্তান এবং ভারতেও জিডিপির ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করে সেখানে বাংলাদেশে তা ২ শতাংশেরও কম। ৫ বছরের মধ্যে কীভাবে এই বরাদ্দ ৪ শতাংশে নেওয়া যায় তার একটি রূপরেখা তুলে ধরেন।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ বলেন, আমাদের দেশে শিক্ষা, জ্বালানি ও পানিসহ বিভিন্ন খাতে যেসব নীতি প্রণীত হয়, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোনো সংযোগ নেই। দেশের নীতিমালা প্রণয়ণে যুক্ত করা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য বা লাভ কী?
একইসাথে তিনি শিক্ষা জ্ঞান ও মর্যাদার ভিত্তিতে নিয়োগ, বাজারের চাহিদার সাথে শিক্ষার সমম্বয়, শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দসহ শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে নিজের মতামত তুলে ধরেন।
এএ/
Share your comment :