রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়:উপদেষ্টা নাহিদ
বাংলাকণ্ঠ রিপোর্ট:
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ইস্যুটি ধারাবাহিকভাবে ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। বিগত সরকারের আমলে নির্বাচিত এ রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ অথবা অপসারণ দাবিতে অনড় রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। দাবি আদায়ে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটামও ঘোষণা করা হয়েছিল। গতকালও কয়েকটি সংগঠন বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভের চেষ্টা করে। বিষয়টি কেন্দ্র করে বঙ্গভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করেছে সরকার। সন্ধ্যায় বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল ও রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণ দাবিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি ইস্যু কেন্দ্র করে এ মুহূর্তে দেশে কোনো সাংবিধানিক সংকট দেখতে চায় না দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, ফ্যাসিবাদ ও তাদের দোসররা দেশে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় সংকট তৈরির চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে সবার সজাগ থাকা প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে দলটির প্রতিনিধিরা তাদের এমন মনোভাবের কথা তুলে ধরেছেন। আরেক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ তুললেও তার পদত্যাগ কিংবা অপসারণ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেননি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ প্রশ্নে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপতি তার পদে থাকবেন কি থাকবেন না, এটি সাংবিধানিক প্রশ্ন নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে সবাইকে ধৈর্য ধারণ করার পরামর্শ দেন তিনি। এমন প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতির অপসারণ ও পদত্যাগ ইস্যুটি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মন্তব্যের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে তার বিদায়ের দাবি উঠেছে। তবে আইন ও সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে সরানোর সুযোগ আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আইনজ্ঞরা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী, একমাত্র জাতীয় সংসদে অভিশংসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা যায়। তবে বর্তমানে সংসদ বহাল না থাকায় সেটির সুযোগ নেই। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি স্পিকারের কাছে পদত্যাগ করতে পারেন। এরপর স্পিকারই ভারপ্রাপ্ত হিসেবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এ পদে আসীন হবেন। কিন্তু স্পিকার নিজেই বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে পলাতক রয়েছেন। আন্দোলনকারীরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর ‘আইন ও সংবিধানের‘ গুরুত্ব কমে গেছে। এ ছাড়া শেখ হাসিনা যেখানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, সেখানে পদত্যাগের কোনো প্রশ্নই আসে না। সেজন্য বিষয়টি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করে রাষ্ট্রপতি তার শপথ ভঙ্গ করেছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এ পদে থাকার নৈতিক অধিকার তার নেই। শেখ হাসিনার পছন্দের ও নিয়োগকৃত এ রাষ্ট্রপতিকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে, না হয় সরিয়ে দিতে হবে।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে মঙ্গলবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠন। তার পদত্যাগ দাবিতে ওইদিন গভীর রাত পর্যন্ত বঙ্গভবন ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তারা নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ার চেষ্টাও করেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধলে কয়েকজন আহত হন। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম গিয়ে তাদের নিবৃত্ত করেন। গতকাল বুধবারও কয়েকটি সংগঠন বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের চেষ্টা করে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতির বাসভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করে প্রশাসন।
এদিকে বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল ও রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণ দাবিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি। সন্ধ্যা ৭টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘৭২-এর মুজিববাদী সংবিধান বাতিল ও রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অপসারণের’ দাবিতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন থেকে এ আহ্বান জানানো হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলমসহ অন্য সমন্বয়ক এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যরা এতে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলন থেকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এবং জাতীয় পার্টি ছাড়া সব রাজনৈতিক দলকে জাতীয় ঐক্যের ডাকে সাড়া দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, কোনো দল যদি বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল ও রাষ্ট্রপতির অপসারণ দাবিতে জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে না আসে, তাহলে ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সেই দলকেও আমরা বয়কট করব। আমরা বাহাত্তরের পচা-গলা সংবিধান মানব না। বাহাত্তরের সংবিধান থাকলে রাজনৈতিক সংকট দূর হবে না।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যু নিয়ে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের সমালোচনা করে এর আগে কড়া বক্তব্য দেন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন মিথ্যাচার করেছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি তার শপথ ভঙ্গ করেছেন। আর আইন উপদেষ্টার এমন বক্তব্যই সরকারের বক্তব্য বলে জানায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। অন্যদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে নতুন কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না করতে আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এমন প্রেক্ষাপটে নতুন এ ইস্যু নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনায় গতকাল বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
এদিকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণের বিষয়টি কোনোভাবেই সমর্থন করছে না বিএনপি। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে—এমন অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন দলটির নেতারা। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, নজরুল ইসলাম খান ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। এতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত হবে। তাই এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির অপসারণ চায় না বিএনপি।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রপতি পদে শূন্যতা, রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হলে দেশে গণতন্ত্র উত্তরণের পথ বাধাগ্রস্ত করবে। সুতরাং ফ্যাসিবাদের দোসররা যেন কোনো ষড়যন্ত্র করতে না পারে, সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
আর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবি নিয়ে কোনো ডেভেলপমেন্ট (অগ্রগতি) হলে জানানো হবে। দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক শেষে প্রেস বিফ্রিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। আইন উপদেষ্টার বক্তব্যে সরকার একমত পোষণ করেছে, তাহলে পরবর্তী ধাপ হিসেবে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে—এমন প্রশ্নে শফিকুল আলম বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা বলতে পারি, কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত হয়নি।
রাষ্ট্রপতি অপসারণের বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে শফিকুল আলম বলেন, আমাদের অবস্থান তো আপনারা দেখছেন, যারা বিক্ষোভ করছে, তাদের বলেছি, তারা যেন বঙ্গভবনের পাশ থেকে সরে যান। গতকাল থেকে বঙ্গভবনের আশপাশের সিকিউরিটি বাড়িয়েছি।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ প্রশ্নে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, রাষ্ট্রপতি তার পদে থাকবেন কি থাকবেন না—এটি সাংবিধানিক প্রশ্ন নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এ কথা বলেন।
নাহিদ বলেন, জনগণের চাওয়া বুঝতে পেরেছে সরকার। সবাইকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। তাই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত আসতে সময় লাগছে। বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ না করারও পরামর্শও দেন তিনি।
তিনি বলেন, আমরা সবাই জানি একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের সমর্থনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা সেই সময় বিদ্যমান যে সংবিধান এবং রাষ্ট্রপতিকে রেখেই সরকার গঠন করেছিলাম। কিন্তু যদি আমাদের মনে হয় এই সেটআপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে অথবা জনগণ এই সেটআপে অসন্তুষ্ট, তাহলে এ বিষয় নিয়ে আমরা ভাবব এবং পুনর্মূল্যায়ন করব।
সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে একটা আলটিমেটাম দিয়েছে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে একটা আলোচনা করছি। এ বিষয়ে কোনো নির্ধারিত সময় নেই। আমরা আলোচনা করছি। যখন আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে যেতে পারব, যেটা আমাদের রাষ্ট্র এবং জনগণের পক্ষে যাবে, সে সময় আমরা সিদ্ধান্ত নেব এবং সবাইকে জানিয়ে দেব।
এএ/
Share your comment :