ডলার সংকট কাটাতে যেভাবে ভারসাম্য আনতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
প্রায় দুই বছর ধরে চলমান ডলার সংকট কাটাতে আমদানি-রপ্তানিতে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংকটের টেকসই সমাধানে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অংশ হিসেবে আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের মধ্যে ভারমাস্য আনার পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য আমদানি ব্যয় কমানো ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণের চাপ কমিয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, ডলার সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার নেপথ্যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতাই দায়ী। ডলার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় সংকট দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। ডলার আয়-ব্যয়ের প্রধান খাত রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে ঘাটতি প্রলম্বিত হয়েছে। এতে সংকট বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার ৭০ শতাংশই আসে রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে। রেমিট্যান্সের মাধ্যমে আসে ২৮ শতাংশ।
বাকি ২ শতাংশ আসে বৈদেশিক বিনিয়োগ, ঋণ ও অন্যান্য খাতে। ব্যয়ের প্রধান খাত হচ্ছে আমদানি। এর বাইরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ও দেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা পাঠানো।
গত কয়েক বছর ধরেই বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়েছে। এতে ডলারের চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এ ঘাটতি বেড়ে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে উঠেছিল। এরপর থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় এখন ঘাটতি কমে আসছে। গত অর্থবছরে এ খাতে ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ৩৩৪ কোটি ডলারে। চলতি অর্থবছরের জুলাই ডিসেম্বরে ওই ঘাটতি মিটিয়ে ৫৫ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে। তবে ডলারের সার্বিক হিসাবে এখনো ঘাটতি রয়ে গেছে। চলতি হিসাবের ঘাটতি মিটিয়ে উদ্বৃত্ত হলে পর্যায়ক্রমে সার্বিক হিসাবেও ঘাটতি কমে যাবে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত হচ্ছে রপ্তানি আয় ব্যয়ের প্রধান খাত হচ্ছে আমদানি। এ দুটির মধ্যে ভারসাম্য নেই। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি ৩০ শতাংশ। আগে আরও বেশি ছিল। রপ্তানির চেয়ে আমদানি ৪৫ শতাংশ বেশি ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে আমদানি কমিয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত আমদানি বেড়েছে। ওই সময়ে বাজারে ডলারের প্রবাহ বেশি থাকায় আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ফলে আমদানি বেড়েছে। একই সঙ্গে আমদানিনির্ভর ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে দেশে।
২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডলার সংকট শুরু হওয়ায় আমদানিতে লাগাম টানা হয়েছে। এতে আমদানিনির্ভর ব্যবসার প্রসার কমতে থাকে। আমদানিতে আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে এ খাতের ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। যা এখনো চলমান। ডলার সংকটের টেকসই বা স্থায়ী সমাধানের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ও ব্যয়ে মধ্যকার ভারসাম্য রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ব্যয়ের খাত কমানো হচ্ছে। আয়ের খাত বাড়ানো হচ্ছে। ব্যয়ের খাতের মধ্যে প্রধান হচ্ছে আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণ নিয়ন্ত্রণ। আয়ের খাতের মধ্যে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানো।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছিল ১৬.৯৩ শতাংশ। একই বছরে আমদানি ব্যয় হয়েছিল ৫ হাজার ৩২৫ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছিল ১০.৮৮ শতাংশ। অর্থাৎ আয় কমেছিল বেশি, ব্যয় কমেছে তুলনামূলক কম। ফলে ডলারের ঘাটতি বেড়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৫.১০ শতাংশ। একই বছরে আমদানি হয়েছিল ৫ হাজার ৭২৬ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭.৫২ শতাংশ বেশি। ওই বছরে আয় বাড়ার তুলনায় ব্যয় বাড়ার হার কমলেও সার্বিকভাবে ঘাটতি ছিল।
২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার। আগের চেয়ে প্রবৃদ্ধি বেশি হয় ৩৪.৩৮ শতাংশ। একই বছরে আমদানি হয় ৮ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলার। আগের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয় ৪৬.১৫ শতাংশ বেশি। এ বছরে আবার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি বেড়ে যায়। ফলে ঘাটতিও বাড়ে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলার। আগের বছরের চেয়ে ৬.৬৭ শতাংশ বেশি। ওই বছরে আমদানি হয় ৭ হাজার ২৮৬ কোটি ডলার। আগের বছরের চেয়ে ১২.৯৪ শতাংশ কম। আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে ব্যয় কমেছে, আয় কিছুটা বেড়েছে।
গত অর্থবছরের জুলাই ডিসেম্বরে রপ্তানি হয় ২ হাজার ৭৩১ কোটি ডলার। যা আগের বছরের চেয়ে ১০.৫৮ শতাংশ বেশি। ওই বছরের একই সময়ে আমদানি হয় ৪ হাজার ১১৮ কোটি ডলার। যা আগের বছরের চেয়ে ১২.৩৮ শতাংশ কম।
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ০.৮৪ শতাংশ বেশি। একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৩ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৮.১৯ শতাংশ কম। এভাবে আমদানি রপ্তানিতে ভারসাম্য আনা হচ্ছে।
একইভাবে বৈদেশিক ঋণ নেয়ার পরিমাণ কমানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে পরিশোধ। ফলে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি কমে এসেছে। এর স্থিতি এক বছরের ব্যবধানে ৯ হাজার ৮০০ কোটি ডলার থেকে কমে ৯ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে নেমেছে। এক বছরে ঋণ কমেছে ৪০০ কোটি ডলার।
এদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে হুন্ডি কমাতে ব্যাংকিং সেবার পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। যেসব দেশে হুন্ডি বেশি হচ্ছে ওইসব দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে হুন্ডির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। গত এক বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে হুন্ডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স বেড়েছে পৌনে ৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ।