নোবিপ্রবি

প্রকৃতি ও বিজ্ঞান মিলেমিশে একাকার

নোবিপ্রবি
নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসের একাংশ  © ফাইল ছবি

বয়সের বিচারে বলা চলে এখনো নবীন। তাই তার সৌন্দর্য্য যেন যৌবণদীপ্ত তারুণ্যের মতই উচ্ছ্বল। চারদিকে চির সবুজের হাতছানি যেন সুন্দরের দ্যুতির পসরা সাজিয়ে বসে আছে কারো অপেক্ষায়। তার শান্ত-শিষ্ট প্রকৃতি এখানে এতটাই কোমল ও নিষ্পাপ যে কেউ প্রেমে পড়বে তার রূপ-লাবণ্যে। এমনই ছায়াঘেরা বিস্তৃত প্রকৃতির কােলে ফি বছর আলিঙ্গন করে বিদ্যুৎসাহীদের। এই গল্প কোনো সবুজ পাহাড় কিংবা সমুদ্র সংলগ্ন প্রকৃতির নয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি)।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল নোয়াখালীতে অবস্থিত নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি) দেশের ২৭তম সরকারি এবং পঞ্চম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৩ সালের ১১ অক্টোবর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বীজ বপন হয় যার একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৬ সালের ২২ জুন।

শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় নজর দেওয়া হয় এখানে। ফলে সময়ের সাথে সাথে এটি শুধু এখন আর একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয় এ যেন প্রকৃতির মাঝে গড়ে ওঠা এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তার মনোরম ক্যাম্পাস, সুপরিকল্পিত স্থাপত্যশৈলী এবং সবুজের সমারোহের কারণে সকলের নজর কাড়ে। ২০০৩ সালের অক্টোবরে তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। পর্যায়ক্রমে ২০০৫ সালের ২৪ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ২০০৬ সালের ২৩ জুন এর প্রথম একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। মাত্র ৪টি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টি ক্রমেই বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় ইতিমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে।

নোয়াখালী জেলা শহর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে সোনাপুর-সুবর্ণচর সড়কের পশ্চিম পাশে ১০১ একর জায়গা জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি অবস্থিত। এর প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে সুপ্রশস্ত রাস্তা, যার দু'পাশে সারি সারি গাছ আর দৃষ্টিনন্দন ল্যান্ডস্কেপিংয়ে ঘেরা। ক্যাম্পাসের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত প্রশাসনিক ভবন। গোলচত্বরে যত্ন করে সাজানো বাগান এবং বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ ক্যাম্পাসের শোভা বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে এসব গাছে নতুন ফুল ফোটে, যা এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশে।

নোবিপ্রবির দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস

 

নোবিপ্রবির অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হলো এর সুবিশাল দিঘী, যা ক্যাম্পাসে সকলের কাছে নীলদিঘী নামে পরিচিত। স্বচ্ছ জলের এই দীঘির চারপাশে রয়েছে সবুজের হাতছানি। দীঘির ধারে বসে শিক্ষার্থীরা আড্ডা দেয়, গল্প করে কিংবা প্রকৃতির নিস্তব্ধ সৌন্দর্য উপভোগ করে। সকাল বা সন্ধ্যায় এই নীলদীঘির পাড়ে হাঁটতে বের হলে এখানকার নির্মল বাতাস মনকে সতেজ করে তোলে। দীঘির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদু বাতাস ও পাখির কিচিরমিচির শব্দ এক অসাধারণ শান্ত পরিবেশ তৈরি করে, যা শহুরে কোলাহল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ক্যাম্পাসের প্রতিটি ভবন, আবাসিক হল এবং শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আবাসন এলাকাও পরিবেশবান্ধব উপায়ে নির্মিত। প্রতিটি ভবন ঘিরে রয়েছে সবুজ ঘাসের লন এবং নানা ধরনের গাছপালা, যা উষ্ণ আবহাওয়ার মধ্যেও ক্যাম্পাসের পরিবেশকে শীতল ও আরামদায়ক রাখে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে রয়েছে একটি সুন্দর শহীদ মিনার, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর প্রতীক। এটি শুধু একটি স্মৃতিস্তম্ভই নয় বরং এর চারপাশে গড়ে ওঠা বাগান ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ এটিকে একটি শান্ত ও পবিত্র স্থানে পরিণত করেছে। শিক্ষার্থীরা প্রায়শই এখানে আসে এবং নিরিবিলি পরিবেশে সময় কাটায়।

এছাড়াও ক্যাম্পাসের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ছোট ছোট বাগান, বসার স্থান এবং খেলার মাঠ শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা রাস্তাগুলো পরিচ্ছন্ন এবং সুবিন্যস্ত, যা হেঁটে চলার জন্য খুবই উপযোগী। রাতে যখন ক্যাম্পাস আলোকিত হয়, তখন এখানকার দৃশ্য আরও মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে। এখানকার কাশফুল বনে যে কারোই হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের  ক্যাম্পাস বাইরের মানুষের জন্য উন্মুক্ত এবং প্রতি শুক্রবারে অনেকেই এখানে ঘুরতে আসেন। এটি নোয়াখালী জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নয়, এটি এমন একটি স্থান যেখানে প্রকৃতি ও আধুনিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। শুরুতে মাত্র ৪টি (কম্পিউটার বিজ্ঞান ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশল, মৎস্য ও সামুদ্রিক বিজ্ঞান, ফার্মেসী, ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগ) নিয়ে শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৩১ টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। এসব বিভাগ ও  ইনস্টিটিউটে বর্তমানে প্রায় ৮ হাজারের মতো শিক্ষার্থীর পাঠদান চলছে। এসব শিক্ষার্থীদের জন্য বর্তমানে পাঁচটি হল রয়েছে। এরমধ্যে ছেলেদের জন্য ২টি ও মেয়েদের জন্য ৩টি হল আছে। এসব হলগুলো আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত, যা দেখতে বেশ নান্দনিক।

দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে অবদান রাখা ব্যাক্তিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এসব হলগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। এরমধ্যে মহান ভাষা শহীদ আবদুস সালাম হল, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক উকিল হল, বিবি খাদিজা হল, জুলাই শহিদ স্মৃতি ছাত্রী হল এবং নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হল অন্যতম। 

এছাড়া ছাত্র-শিক্ষকদের গবেষণা ও পাঠের জন্য ২০১৭ সালে নোবিপ্রবিতে ১০ হাজার স্কোয়ার ফিটের একটি নতুন লাইব্রেরি ভবন স্থাপন করা হয়। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ তলা বিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবন, ৫ তলা ও ১০ তলা বিশিষ্ট দুইটি একাডেমিক ভবন, ৫ তলা বিশিষ্ট একটি অডিটরিয়াম ভবন রয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন-এর নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত এ অডিটোরিয়ামটির আসন সংখ্যা প্রায় ১০০০। ২০১৮ সালে এখানে আরেকটি একাডেমিক কাম ল্যাব ভবনের কাজ শুরু হয়েছে যার আয়তন ৪ লক্ষ ৩২ হাজার বর্গফুট। এটিই বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সর্ববৃহৎ একাডেমিক ভবন হবে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ম ও বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইসমাইল।

এখানকার শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা এবং অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে এবং তাদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক বেশ কয়েকটি প্রসিদ্ধ ক্লাব রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বাংলা সংসদ, নোবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতি, ছায়া জাতিসংঘ, ডিবেটিং সোসাইটি, চলো পাল্টাই ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, নোবিপ্রবি ট্যুরিজম ক্লাব, শব্দকুটির, নিরাপদ খাদ্য ও সচেতন ভোক্তা আন্দোলন (এসএফসিসিএম), সমকাল সুহৃদ সমাবেশ, প্রথম আলো বন্ধুসভা, সায়েন্স ক্লাব, গবেষণা সংসদ, বিজনেস ক্লাব, ধ্রুপদ, ড্যান্স ক্লাব, চিত্রকৃৎ, বিএমএস ক্যারিয়ার ক্লাব, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব এবং ইনডিজিনাস স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। এসব ক্লাব শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়ে তাদের ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্বগুণ এবং সমাজসচেতনতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

সবমিলিয়ে এখানকার মনোরম পরিবেশ শিক্ষার্থীদের মনকে সতেজ রাখে এবং পড়াশোনার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ক্যাম্পাসগুলোর মধ্যে একটি, যা শিক্ষাক্ষেত্রে একটি আদর্শ পরিবেশ নিশ্চিত করে।


মন্তব্য