৩৫ বছর ধরে কাঁধে জোঁয়াল, খোলা আকাশের নিচে জীবনযুদ্ধ

ঘানী
  © বাংলাকণ্ঠ

সিরাজগঞ্জে গরুর পরিবর্তে কাঁধে জোঁয়াল নিয়ে কাঠের ঘানী টেনে সংসার পরিচালনা করছেন মমতা পরিবার। ২

সরজমিনে ঘটনাস্হলে গিয়ে যানা যায়, সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলার জামতৈল ইউনিয়নের বড়কুড়া সাকিনের মৃত বাহাদুর আলীর কন্যা মোছাঃ মমতা খাতুনের সাথে একই উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের ক্ষিদ্রা ভদ্রঘাট সাকিনের মৃত কাজেম উদ্দিনের পুত্র আকবর আলীর সাথে বিবাহ হয়। বিয়ের পরে কিছুদিন সংসার ভালো কাটলেও পরবর্তীতে তাদের সংসার জীবন বড়ই কষ্টের, অর্ধাহারে অনাহারে তাদের দিন কাটে। ইতিমধ্যে মমতা-আকবরের দাম্পত্য জীবনে পরপর ফরিদুল ইসলাম, আল আমিন ও মিম নামে ২ টি পুত্র ও ১ টি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। ৫ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের সকল সদস্যদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্হান ও চিকিৎসার ব্যবস্হা করতে গিয়ে অত্যধিক দুঃশ্চিন্তায় আকবর আলী অসুস্হ হয়ে পরে। তখন থেকে আকবর আলী আর ভারী কোন কাজ করতে পারে না। 

এদিকে অসুস্হ ও কর্মবিমুখ আকবর আলী অনন্যেপায় হয়ে পিতার প্রাপ্য অংশ ৪ শতক বসতবাড়ি বিক্রি করে সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক বাজার সওদা চাল – ডাল কেনার পর অবশিষ্ট টাকা দিয়ে স্ত্রী মমতা খাতুনের পৈত্রিক আদি পেশা সরিষা ভাংঙ্গানোর “কাঠের ঘানী” তৈরীর সরঞ্জামাদী কিনে ঘানী তৈরী করে কাঁধে জোঁয়াল টেনে সরিষা ভাঙ্গিয়ে তেল ও খৈল বিক্রি করে কোন মতে সংসার চলতে থাকে। এরই মধ্যে নিঃস্ব সহায় সম্বলহীন আকবর তার বোনের অনুমতি নিয়ে বোনের প্রাপ্য বাপের ২ শতক ভিটাতে আকবর আলী কাঁচা বেড়ার ঘড় নির্মান করে তথায় বিবি বাচ্চা নাতি নাতনী নিয়ে বসবাস করছে। বর্তমানে মামতা – আকবর পরিবারে সদস্য সংখ্যা মোট ১০ জন। তাদের বড় ছেলে ফরিদুল ইসলাম (৩৫) একজন মানসিক ভারসাম্যহীন রুগী। ফরিদুলের ওষুধ পথ্যসহ তার ২ টা পুত্র সন্তানের ভরণ-পোষনের ব্যবস্হা মমতা দম্পতিই করে থাকে। তদুপরি মেঝ ছেলে আল আমিন(৩৩) রাজমিস্ত্রীর কাজ করলেও এখনও সে বউ নিয়ে বাবা – মায়ের আয়ের উপরই নির্ভরশীল। এ ছাড়াও একমাত্র বিবাহিতা কন্যা মিম (২৮) তার অকর্মা স্বামীসহ এখনও পিতার সংসারেই অবস্হান করছে। 

এমন পরিস্থিতিতে মমতা দম্পতির পক্ষে খোলা আকাশের নিচে গরুর পরিবর্তে কাঁধে জোঁয়াল টেনে সরিষা ভাঙ্গিয়ে উপার্জিত সামান্য আয় দিয়ে তাদের বিশাল পরিবার পরিচানা করা খুবই কঠিন হয়ে পরেছে। ঘানীর ঘড় না থাকায় বৃষ্টি মৌসুমে খোলা আকাশের নিচে ঘানী টানা যায় না। সার্বিক বিষয়ে কথা হয় কাঁধে জোঁয়াল নিয়ে ঘানী টানার একমাত্র চালিকা শক্তি মমতা খাতুনের সাথে। একটি কাঠের ঘানী তৈরী প্রসংঙ্গে তিনি বলেন, একটা কাঠের ঘানী তৈরী করতে ১টা গাছ, ডালা, জাঠ, জিহ্বা, লাকরী, সকতন, দড়ি, বাহর, ২/৩ টা বড় পাথর, জোঁয়াল প্রয়োজন। আর এগুলি কিনতে প্রায় ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার) টাকার দরকার হয়। এছাড়াও সরিষা, তেল রাখার পাতিল ও ঘানী টানতে প্রায় ৩ জন লোক লাগে। 

দিনে কতটুক সরিষা ভাঙ্গিয়ে কতটুকু তেল ও খৈল পাওয়া যায় এমন প্রশ্নের জবাবে মমতা বলেন, দিনে ১০ কেজি সরিষা ভাঙ্গানো যায়। ১০ কেজি সরিষা ভাঙ্গিয়ে ১.৫ দেড় কেজি তেল এবং ৭.৫ সাড়ে সাত কেজি খৈল পাওয়া যায়। ১০ কেজি সরিষা কিনতে ১০০০/-(একহাজার) টাকা লাগে। আর প্রতি কেজি তেল ৪০০/- এবং প্রতি কেজি খৈল ৬০ টাকা দরে বিক্রি করা যায়। এতে সরিষা ক্রয় এবং তেল ও খৈল বিক্রি করে যোগ বিয়োগে কিছুই উদ্বৃত্ত থাকে না তদুপরি ৩ জন (মমতা নিজে, স্বামী আকবর ও মেয়ে মিম) লোকের নিয়োজিত শ্রম?

তিনি আরও বলেন, মমতা দম্পতি’র কোন সদস্যই সরকারের দেওয়া কোন সুযোগ সুবিধা যেমন প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ভাতা এবং ভিজিডি’র মতো কোন কিছুই  তারা ভোগ করে না। এমনকি তারা কখনও স্হানীয় প্রশাসনসহ উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের সুনজরেও আসেনি। এদিকে টাকার অভাবে মমতা খাতুনের অসুস্হ স্বামীর চিকিৎসাও হচ্ছে না।

তাই ঘাঁনী রাখার জন্য আধুনিক মানের একটা ঘড়, কাঠের ঘানী’র সরঞ্জামাদি কেনার জন্য থোক টাকার ব্যবস্হা, ঘানী টানার জন্য ২ টা বলদ গরুসহ ভিজিডি, প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক ভাতা’র মতো সুযোগ সুবিধার ব্যবস্হা করার জন্য সরকারের তৃণমূল পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা যেমন সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক, স্হানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক, পুলিশ সুপার, কামারখন্দ উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যেসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের একান্ত সাহা্য্য সহযোগিতা কামনা করছেন অসহায় মমতা দম্পতি।  


মন্তব্য