দূর্নীতিতেও হ্যাট্রিক সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে দুদকের এ্যাকশন
- বিশেষ প্রতিনিধি:
- প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:১৭ PM , আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:২৫ PM

এক সময়ের তুখোড় ফুটবলার আব্দুস সালাম মুর্শেদীর দূর্নীতির গল্প যেন রূপকথার মতই। খেলার মাঠ ছেড়ে ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লেখানোর পরই রীতিমত একের পর এক হ্যাট্রিক করতে থাকেন অবৈধভাবে অর্থ আদায়ে। এক্ষেত্রে বেচে নেন রাজনীতিকে। আর সেই রাজনীতিই কাল হয়ে দাড়িয়েছে এ তারকা খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারে। এবার তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে ৭৮টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে সহসাই মাঠে নামছে সংস্থাটি।
জানা গেছে, ফুটবল ছেড়ে ব্যবসায়ী বনে যাওয়া সালাম মুর্শেদীর মূল উত্থান হয় রাজনীতিতে নাম লেখানোর পরই। তবে এ মাঠে সে যতটা সফল হয়েছেন, তার চেয়েও বেশি ফাউল করেছেন সাফল্যের বল জালে ঢোকাতে।
মূলত রাজনৈতিক উচ্ছাভিলাসী মুর্শেদী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়েই একের পর এক কেলেঙ্কারিতে মগ্ন হয়ে পড়েন। বিশেষ করে ব্যবসা ও সম্পদ বাড়াতে ব্যবহার করেছেন সংসদ সদস্যপদ। আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরে তার ব্যক্তিগত বৈধ সম্পদই বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে (বাফুফে) আর্থিক অনিয়মের দায়ে ফিফার শাস্তি, গুলশানের বাড়ি তেলেসমাতির মতো একের পর এক অপকর্ম করেই গেছেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। হাসিনার পতনের পর ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন সাবেক এ তারকা ফুটবলার।
এদিকে সালাম মুর্শেদী ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে ৭৮টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে দুদক। আব্দুস সালাম মুর্শেদীর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে তার স্ত্রী শারমিন সালাম, মেয়ে শেহরিন সালাম, পুত্র ইশমাম সালাম। শুধু অবৈধ সম্পদ নয়, সালাম মুর্শেদী ও তার পরিবারের সদস্যদের অর্থপাচারের অভিযোগও অনুসন্ধান করছে দুদক। দুদকের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন অভিযোগটির অনুসসন্ধান চালাচ্ছেন।
সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে জাল রেকর্ড তৈরি করে দখল করা গুলশানের একটি প্লট দখল, প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির মামলার আসামি হয়েছেন মুর্শেদী। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বাফুফের আর্থিক অনিয়মের দায়ে ফিফার শাস্তি পাওয়ার বিষয়ও রয়েছে। সবমিলিয়ে সালাম মুর্শেদীর চোখে যেন এখন সর্ষে ফুল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, সরকারি নথি জালিয়াতির মাধ্যমে জাল রেকর্ডপত্র তৈরি করে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হস্তান্তর, অনুমতি ও নামজারি করে গুলশান-২ আবাসিক এলাকার ১০৪ নম্বর সড়কের ২৭/বি নম্বরে ২৭ কাঠা সরকারি সম্পত্তি আত্মসাত করেন আব্দুস সালাম মুর্শেদী।
এই ঘটনায় জড়িত রাজউক কর্মকর্তাদের আসামি করা হলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সালাম মুর্শেদী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আসামি তালিকার বাইরে ছিলেন। প্রথম অবস্থায় ক্ষমতার জোরে বেঁচে গেলেও তদন্ত পর্যায়ে আসামি করা হয় সালাম মুর্শেদীকে। সেইসঙ্গে আসামির তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ওই সম্পত্তি দখল করা অপর অংশীদার ইফফাত হক ও তার স্বামী মোহাম্মদ আব্দুল মঈন। এ দম্পতি ২৭ কাঠার মধ্যে ১২ কাঠা দখল করেছিলেন। বাকি ১৫ কাঠা দখল করে বাড়ি নির্মাণ করেন সালাম মুর্শেদী। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর বিশেষ জজ আদালতে এ সংক্রান্ত মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। দুদকের তৎকালীন উপ-পরিচালক আনোয়ারুল হক ও উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন ওই মামলাটি তদন্ত করেন।
দুদকের একজন সহকারী পরিচালক জানিয়েছেন, আব্দুস সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে সরকারি বাড়ি দখল ছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি, ফ্ল্যাট ক্রয়ের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সালাম মুর্শেদী ও তার স্ত্রী, সন্তানদের নামে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে পৃথক অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনুসন্ধান পর্যায়ে তাদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, সংসদ সদস্য হয়ে ব্যবসার পাশাপাশি সম্পদ বাড়ানোয় মন দিয়েছিলেন সালাম মুর্শেদী। সংসদ সদস্য হওয়ার পর পাঁচ বছরে আরও ৪৩ কোটি টাকা আয় করেন তিনি। তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের সম্পদ পাঁচ বছরে ১৮ গুণ বেড়েছিল। এমপি থাকাকালে মুর্শেদীর বার্ষিক আয়ও বাড়ে। পাঁচ বছর আগে তাঁর বার্ষিক আয় ছিল ৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এখন তাঁর বার্ষিক আয় আট কোটি দুই লাখ টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় উল্লেখ রয়েছে, তাঁর হাতে নগদ টাকা রয়েছে ২৯ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। ব্যাংকে জমা রয়েছে ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বিভিন্ন কোম্পানিতে মুর্শেদীর শেয়ার আছে ৯৪ কোটি ৪২ লাখ টাকার। স্থাবর সম্পদের মধ্যে ১১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা দামের ভবন। গাড়ি, গৃহ, সম্পত্তি ছাড়াও অন্যান্য অস্থাবর সম্পদ রয়েছে ২৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকার। ব্যাংকে তাঁর ঋণ আছে ৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। মুর্শেদীর স্ত্রীর কাছে ১ কোটি ৮৬ লাখ নগদ টাকা, ব্যাংকে ১৭ লাখ ৭৪ হাজার টাকা এবং ৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকার শেয়ার আছে। অন্যান্য সম্পদ রয়েছে ৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকার। ২০১৮ সালে মুর্শেদীর হলফনামায় উল্লেখ ছিল, তাঁর বার্ষিক আয় ৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। তাঁর স্ত্রীর বার্ষিক আয় ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। তাঁর নিজের ৯৫ কোটি ১১ লাখ টাকার, স্ত্রীর ২২ কোটি ৩১ লাখ টাকার এবং নির্ভরশীলের (মেয়ে) ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকার সম্পদ রয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকায় নিজস্ব বলয় তৈরি করেন মুর্শেদী। আওয়ামী লীগের ভেতর তৈরি হয় এমপি লীগ। এমপি থাকাকালে রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়ার ঘাট, পুকুর, জলমহাল, বালুমহালসহ সরকারি সম্পত্তি ছিল মুর্শেদীর অনুসারীদের দখলে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীও। রূপসায় কয়েক দফা মুর্শেদী অনুসারীদের হামলায় ঘরছাড়া হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী। বিএনপি কর্মীরাও এলাকায় ঢুকতে পারেননি। তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ মানুষ গত ৫ আগস্ট কাস্টমঘাটের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আগুন দেয়।
১৯৮৪ সালে মুর্শেদী তৈরি পোশাক ব্যবসায় যুক্ত হন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি হন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) সভাপতি ছিলেন। ব্যবসায়ী সমিতির শীর্ষ পদগুলো তিনি ব্যবহার করেছেন ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং নিজের ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে। নির্বাচনে জালিয়াতি, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে বহুবার।