ট্রাম্পের ৩ মাস শেষ ৯ জুলাই, পাল্টা শুল্কারোপের শঙ্কা

ট্রাম্প
  © ফাইল ছবি

গত ৩ এপ্রিল হঠাৎ ট্রাম্প প্রশাসন হাঠাৎ বাংলাদেশের ওপর পাল্টা অর্থাৎ বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। এতে মোট শুল্ক দাঁড়ায় ৫২ শতাংশ। শুল্ক আরোপের কার্যকরের তারিখ ছিল গত ৯ এপ্রিল। তবে ওই দিনই যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা নতুন শুল্ক হারের ঘোষণাও তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখে। স্থগিতের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৯ জুলাই। 

বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্কারোপ স্থগিতের পর দেশটির সঙ্গে ‘পারস্পরিক শুল্ক চুক্তি’ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যদিও আলোচনায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে, তবে এখনো সমঝোতার পথ পুরোপুরি সুগম হয়নি। দুই দেশের অবস্থানের মধ্যে মৌলিক মতপার্থক্যের কারণে ৯ জুলাইয়ের মধ্যে চুক্তি চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, মূল জটিলতা তৈরি হয়েছে নীতিগত অবস্থানগত পার্থক্য নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, বাংলাদেশের রপ্তানি কার্যক্রম যেন তাদের নিজস্ব আইনের আওতায় পরিচালিত হয়। এছাড়া তারা চাইছে, কোনো তৃতীয় দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বাংলাদেশও যেন একই রকম পদক্ষেপ নেয়। তবে এই অবস্থান বাংলাদেশের বহুপক্ষীয় বাণিজ্যনীতি ও কৌশলগত অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা যেসব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে, সেগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেন অন্য কোনো দেশকে একই ধরনের সুবিধা না দেয়। বাংলাদেশ এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এটি গ্রহণযোগ্য নয়। ঢাকা চায়, চুক্তির আওতায় দুই দেশ যেন একে অপরের পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হারে শুল্ক ধার্য করে এবং কোনো পক্ষ যেন একতরফাভাবে শুল্ক বা বাণিজ্যিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে না পারে।

এ বিষয়ে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানির বাজার। তাই আলোচনা চলছে। আমরা আলোচনাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। তবে তা কখনো জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। আমরা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য। আমাদের যা পদক্ষেপ হবে, তা ডব্লিউটিওর বিধিবিধান মেনেই হবে। এই সীমাবদ্ধতা যুক্তরাষ্ট্রও জানে।”

জানা যায়, পারস্পরিক শুল্কের বিষয়টি নিয়ে চলতি বছরে দুই দেশ ২৮টি বৈঠকে বসেছে। সর্বশেষ গত ২৬ জুন ইউএসটিআর প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বৈঠক করেন। আলোচনা এখনো বন্ধ হয়নি, বরং নতুন বৈঠকের কথা রয়েছে ৩-৪ জুলাই। সেখানে অংশ নেবেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনও। আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে শুল্কসীমা, ট্যারিফ শিডিউল ও আইনি ব্যাখ্যা।

চুক্তির আলোচনায় ভারসাম্য আনতে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু উচ্চমূল্যের পণ্যের আমদানির আশ্বাস দিয়েছে—যেমন গম, এলএনজি, বোয়িং বিমান, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক পণ্য। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোন পণ্যে তারা শুল্কছাড় চাইছে, তার একটি ট্যারিফ শিডিউলও চেয়েছে বাংলাদেশ। তবে এখনো সেই তালিকা পাঠায়নি যুক্তরাষ্ট্র।

বাংলাদেশের প্রস্তাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখনো লিখিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে ঢাকার কূটনৈতিক সূত্র বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। এমনকি ৯ জুলাইয়ের সময়সীমা পার হলেও তারা প্রয়োজনে ৯০ দিন বা তারও বেশি সময় চুক্তির কার্যকারিতা স্থগিত রাখতে পারে। তবে দুশ্চিন্তার জায়গাও কম নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি জানিয়েছেন, ৯ জুলাই থেকে দেশটিতে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ককাঠামো কার্যকর হবে এবং দেশভেদে শুল্কহার নির্ধারণ করে, তা চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। খসড়া পরিকল্পনায় বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের চাপের উৎস মূলত বাণিজ্য ভারসাম্যের বড় ব্যবধান। ২০২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল প্রায় ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে তৈরি পোশাক ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বিপরীতে আমদানি মাত্র ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার—এই বিশাল রপ্তানি উদ্বৃত্ত যুক্তরাষ্ট্রের নজরে এসেছে এবং চুক্তির মাধ্যমে ভারসাম্য আনার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে তারা দেখছে।

এ প্রসঙ্গে সিপিডির বিশেষ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশকে অবশ্যই কৌশলগত অবস্থান অক্ষুণ্ন রেখে চলতে হবে। বাণিজ্যিক সুবিধা থাকলেও রাষ্ট্রীয় অবস্থান জলাঞ্জলি দেওয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র যদি সম্পর্ক ধরে রাখতে চায়, তবে নমনীয় হবে। এ সময় দরকার সংবেদনশীল অথচ সাহসী কূটনৈতিক অবস্থান। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো কী করছে, তার ওপর চোখ রাখতে হবে।”

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগে রয়েছেন দেশের পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের বাজার বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একতরফাভাবে শুল্ক বাড়িয়ে দিলে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকে থাকতে পারব না। চুক্তি হোক, কিন্তু ভারসাম্য রক্ষা করেই। সেটি ৯ জুলাইয়ের মধ্যে সম্ভব না হলে আলোচনা চালিয়ে নেওয়ার সদিচ্ছা দেখিয়ে স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরও ৯০ দিন বা তদূর্ধ্ব বাড়ানোর সময় চাওয়া হোক।”

তাই আপাতত অপেক্ষা ৩-৪ জুলাইয়ের বৈঠকের দিকে। সেখানে নির্ধারিত হতে পারে এই জটিল আলোচনার ভবিষ্যৎ—সমঝোতায় পৌঁছাবে দুই পক্ষ, নাকি সময় চেয়ে আরও এক অধ্যায়ের কূটনৈতিক লড়াই শুরু হবে।


মন্তব্য