যে কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বিনিয়োগকারীরা
- বাংলাকন্ঠ রিপোর্ট:
- প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ০২:৩৬ PM , আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৫, ০২:৩৬ PM
-10444.jpg)
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে এবং এর সুদহার কমিয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের মধ্যে সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে ফেলার প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, পেনশনার এবং ঝুঁকিপূর্ণ বয়স্ক নাগরিকদের কাছে সঞ্চয়পত্রের আকর্ষণ হ্রাস পাচ্ছে।
জীবনযাত্রার ব্যয় মেটানোর একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে পরিচিত সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমিয়ে দেওয়ায় সাধারণ মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত তিন অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে এনেছে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, চলমান মূল্যস্ফীতির মধ্যে সরকার ব্যয়ের পরিমাণ না বাড়িয়ে সংকোচনমূলক বাজেট দিয়েছে। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও চালু করেছে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি। এই পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো একটি সাংঘর্ষিক পদক্ষেপ বলে মনে করছেন তারা।
এর ফলে উচ্চ সুদ প্রদানকারী ব্যাংকগুলোয় অর্থ জমা রাখতে মানুষ আগ্রহ দেখাবে, কিন্তু সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবে না। এতে বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ তুলতে পারবে না। ফলে ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরতা বাড়বে। সরকার যদি ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেয়, তবে তা বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ হ্রাস করবে। এটি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এ বিষয়ে সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, “সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমায় মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা হবে। কারণ, অনেকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দিয়ে সংসার পরিচালনা করেন। আমি মনে করি, সুস্থ বিনিয়োগের স্বার্থে ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া উচিত।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, “সঞ্চয়পত্রে বেশি সুদ দেওয়ায় আর্থিক সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে বন্ড মার্কেট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ খাতে সুদহার বেশি থাকায় বেসরকারি কোম্পানিগুলো বাজারে বন্ড ছাড়তে আগ্রহী হচ্ছে না। আর বন্ড মার্কেট উন্নতি না হলে আর্থিক খাতের উন্নয়ন হবে না। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সরকার ভিন্নভাবেও সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা দিতে পারে। অবসরভোগীদের সুবিধা দিতে হলে সরকার পেনশনের অঙ্ক বাড়াতে পারে।”
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার বিপরীতে আইএমএফ-এর কয়েকটি শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো-সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ কম নেওয়া। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে লাগাম টানতে হবে। শর্ত হলো-ঘাটতি বাজেট পূরণে অভ্যন্তরীণ ঋণের এক-চতুর্থাংশ নিতে হবে সঞ্চয়পত্র থেকে। পাশাপাশি গ্রাহকদের প্রদেয় সুদহার বাজারভিত্তিক চালু করা। আর সুদহার বাজারভিত্তিক হলো-সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। অর্থাৎ ছয় মাসের গড় ট্রেজারি বিলের সুদহারের ভিত্তিতে সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারণ করা। ট্রেজারি বিলের সুদহার বাড়লে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়বে। আর ট্রেজারি বিলের সুদহার কমলে সঞ্চয়পত্রের সুদহারও কমবে।
অর্থ বিভাগ পর্যালোচনা করে দেখেছে-গত ছয় মাসে ট্রেজারি বিলের সুদহার কমেছে। ফলে আইএমএফ-এর শর্ত মানতে গিয়ে ট্রেজারি বিলের সুদের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদহারও কমানো হয়েছে। এ হিসাবে সাড়ে ৭ লাখ টাকার নিচে সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং সাড়ে সাত লাখ টাকার উপরে ১২ দশমিক ৩৭ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশে আনা হয়েছে। মধ্য মেয়াদে সঞ্চয়পত্রের সার্বিক সুদহার ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আইএমএফ ঋণের প্রথম কিস্তি দিয়েছে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ওই বছর সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এরপর পরবর্তী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) এক লাফে ১৮ হাজার কোটি টাকায় আনা হয়। সদ্য বিদায়ি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) আরও কমে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা আরেক দফা কমিয়ে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সঞ্চয়পত্রকে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হিসাবে নিলেও আইএমএফ বলছে, এটি সরকারের একটি দীর্ঘমেয়াদি দায়। কারণ সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে প্রতিবছর বড় অঙ্কের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, সঞ্চয়পত্র সামাজিক সুরক্ষা হিসাবে কাজ করছে। কিন্তু এর বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ও সুদহার কমিয়ে আনায় বড় একটি শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্তের মুখে পড়েছে।