যে ৭ কারণে পণ্যের দাম বেশি দিতে হয় ভোক্তাদের

Market
‘কার্যকর বাজার তদারকির মাধ্যমে ভোক্তা ও ব্যবসায়ের স্বার্থ সুরক্ষা’ বিষয়ক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।  © সংগৃহীত

সরকারের নানান পদক্ষেপের পরও কেন ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বেশি গুনতে হয় এমন কমপক্ষে ৭টি কারণকে চিহৃিত করেছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাজার তদারকির মাধ্যমে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীর স্বার্থ সুরক্ষা ছাড়া কোনাে বিকল্প নেই। 

শনিবার (১৯ জুলাই) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘কার্যকর বাজার তদারকির মাধ্যমে ভোক্তা ও ব্যবসায়ের স্বার্থ সুরক্ষা’ বিষয়ক অংশীজন নিয়ে ডিসিসিআই মিলনায়তনে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।
সেখানে বলা হয়, যথাযথ বাজার তদারকি ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, কৃত্রিম সংকট, নিম্নমানের পণ্য, পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি ও নিরাপত্তাহীনতা, পণ্য আমদানি প্রক্রিয়ার জটিলতা, স্টোরেজ সুবিধার অপ্রতুলতা এবং পণ্য ব্যবস্থাপনায় প্রতিযোগিতার স্বল্পতার কারণে স্থানীয় বাজারে বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ভোক্তার পাশাপাশি ব্যবসায়ী সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা বলছেন, উল্লেখিত বিষয়গুলো চিহৃিত করে ব্যবস্থা গ্রহন করলে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হবে। 

সভায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (খাদ্য শিল্প ও উৎপাদন) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শোয়েব, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ড. মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার এবং জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী বলেন, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্রমাগত সম্প্রসারিত হলেও বাজারে পণ্যের মূল্য কারসাজি, কৃত্রিম সংকট, নিম্নমানের পণ্য, জটিল নিয়মনীতি এবং নানাবিধ হয়রানির কারণে ভোক্তাসহ বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়িত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। ফলে ভোক্তাদের আস্থা কমে যাচ্ছে এবং সৎ ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাজার তদারকির সমন্বিত কাঠামোর রূপরেখা প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন এবং জবাবদিহিতাপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা গঠনের ওপর জোরারোপ করতে হবে।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে অনেকক্ষেত্রে বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পায় এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাসমূহের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, বাজার তদারকির বিষয়টি অতীব জরুরি হলেও, জনবলের অভাবে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৯টিতেই ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের কোনো কার্যালয় নেই, ফলে কার্যকর বাজার তদারকি সম্ভব হচ্ছে না। ভোক্তা অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন আইন ও অধ্যাদেশের মধ্যকার সমন্বয় বৃদ্ধি ও বৈসাদৃশ্য পরিহার একান্ত অপরিহার্য।

মহাপরিচালক বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারণের পরিবর্তে তা চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়া সমীচীন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, পণ্য পরিবহন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে বাজারে বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, স্বল্প সংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য বৃহৎ বেসরকারিখাতের সুনাম নষ্ট হচ্ছে; তাই এই অসাধু ব্যবসায়ীদের রোধে সকল স্তরের সৎ ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে। সমন্বিতভাবে কাজ করার মাধ্যমে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। তবে সমন্বিতভাবে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি কাজে লাগানো সম্ভব হলে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে।   

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ড. মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, বাজারে একটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা থাকা কেবলমাত্র ভোক্তাই নয়, ব্যবসায়ীদের জন্যও সুফল বয়ে আনবে। পণ্য সরবরাহ সংশ্লিষ্ট পর্যাপ্ত তথ্য প্রাপ্তি ও গবেষণা বাজারে অসম প্রতিযোগিতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

মতবিনিময় সভায় মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ গোলাম মওলা, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি খন্দকার মনির আহমেদ, চিনি ও তেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী আবুল হাসেম, বাংলাদেশ সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন এবং ডিপার্টমেন্ট অব পেটেন্টস, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেডমার্কস’র উপ-পরিচালক মির্জা গোলাম সারওয়ার প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।

হাজী মোহাম্মদ গোলাম মওলা বলেন, দেশে সরকারি চিনিকল ১৮টি থাকলেও, এগুলোর বেশিরভাগই এখন কার্যকর নয়, এছাড়াও ভোজ্যতেল রিফাইনারির সংখ্যা ক্রামন্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে কিছুসংখ্যক আমদানিকারকের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি নির্ভর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে অসম প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে পণ্য বিক্রিতে অতি মুনাফা রোধকল্পে খুচরা পর্যায়ে পণ্য বিক্রির মুনাফার হার নির্ধারণ করা যেতে পারে। 

খন্দকার মনির আহমেদ বলেন, ডিমের চাহিদা বছরের সকল সময়ে একই রকম থাকে না, তাই ডিম সংরক্ষণে কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণাগার স্থাপন করা গেলে এই খাতের উদ্যোক্তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস পাবে। দেশের পোলট্রি খাতে বর্তমানে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে, যেখানে প্রায় ৬০ লাখ লোক কর্মরত রয়েছে; এমতাবস্থায় বৃহৎ এই শিল্পখাতকে সরকারের গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

হাজী আবুল হাসেম সরকারি বন্ধ চিনিকলসমূহে সরকারি উদ্যোগে অথবা বেসরকারিখাতের সহযোগিতায় চালু করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তাহলে আমাদের আমদানি নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে, বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। খুচরা পর্যায়ে চিনির মূল্য হ্রাসে চিনির ওপর আরোপিত ট্যাক্স কমাতে হবে। পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি ও ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 

মো. জাকির হোসেন বলেন, বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয় এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিবৃন্দের সমন্বয়ে একটি কার্যকর মনিটরিং সেল স্থাপন করা প্রয়োজন। পণ্য আমদানি কার্যক্রমে নজরদারি বাড়ানো গেলে চাহিদা মাফিক পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কাজী মোহাম্মদ বশির উদ্দিন বলেন, বাজার তদারকির কার্যক্রম চলছে, তবে তা গোছানো নয়। ডলারের সংকটের কারণে ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র খোলার জটিলতার কারণে আমদানি নির্ভর নিত্যপণ্যের সংকটে বাজার পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক গোলাম সারওয়ার বলেন, এ বছর আলুর দাম তুলনামূলকভাবে কম থাকায় কৃষক ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাই কৃষক যদি আলু চাষে নিরুৎসাহিত হয়, তাহলে আগামী বছর ফলন হ্রাস পেলে ভোক্তাদের উচ্চ মূল্যে আলু ক্রয় করতে হবে, তাই আলুর সঠিক মূল্য নির্ধারণে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।

ডিসিসিআই প্রাক্তন সহ-সভাপতি এম আবু হোরায়রাহ্ বলেন, সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন বিভিন্ন বাজার বা মার্কেটের ইজারা ব্যবস্থাকে কঠোর নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। কেননা বর্ধিত ইজারা মূল্যের প্রভাব পরিশেষে ভোক্তাকেই বহন করতে হয়।

এছাড়াও মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই পরিচালক মোহাম্মদ জমশের আলী, এনামুল হক পাটোয়ারী এবং প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুস সালাম প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।

ডিসিসিআই সহ-সভাপতি মো. সালিম সোলায়মান, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ সহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারবৃন্দ এসময় উপস্থিত ছিলেন।


মন্তব্য