বিনিয়োগে আস্থার সংকট

শেয়ারবাজার
  © ফাইল ছবি

প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন অলস টাকা পড়ে আছে ব্যাংকে। কিন্তু দীর্ঘদিনের আস্থার সংকটের কারণে এ অলস টাকা কোথাও বিনিয়োগের কাজে আসছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে নিট উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা—যা বাজারের বাস্তব প্রয়োজনের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

তবে এত বিপুল অর্থ থাকলেও তা অর্থনীতিতে সক্রিয়ভাবে প্রবাহিত হচ্ছে না। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো বিনিয়োগ পরিবেশের অনিশ্চয়তা, ঋণের কম চাহিদা এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি গভীর অনাস্থা। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের নগদ সংকট ও স্বচ্ছতার ঘাটতি পুরো খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে ‘পদ্ধতিগত অনাস্থা’ তৈরি হয়েছে।

এর পাশাপাশি উচ্চ সুদের হার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বাজারে অস্থিরতার কারণে ব্যবসায়ীরা নতুন ঝুঁকি নিতে অনীহা দেখাচ্ছেন। ফলে বিপুল অর্থ ব্যাংকে জমে থাকলেও তা বাস্তব অর্থনীতিতে কাজে লাগছে না।

ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, সরকারের পালাবদলের পর কিছু সংস্কার হলেও বিনিয়োগের পরিবেশ এখনো স্থিতিশীল নয়। উচ্চ সুদের হার, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং পূর্ববর্তী বিনিয়োগের হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে অনেকেই ঋণ নিতে সাহস পাচ্ছেন না, ফলে ব্যাংকে টাকা জমছে কিন্তু তা অর্থনীতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু উদ্বৃত্ত তারল্য দিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল হয় না; এই অর্থ উৎপাদনশীল খাতে প্রবাহিত না হলে এবং মানুষের মনে আস্থা না থাকলে তা কেবল পরিসংখ্যানেই থেকে যাবে।

কিছুটা স্বস্তির খবর এসেছে রেমিট্যান্স ও রিজার্ভের দিক থেকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে প্রবাসী আয় প্রায় ২৭ শতাংশ বেড়ে ৩০.৩৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১.৭৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, হুন্ডি কমায় ডলার ব্যাংকিং চ্যানেলে আসায় ডলারের ওপর চাপ কমেছে এবং বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরেছে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।

তবে ব্যাংকভিত্তিক তারল্যের চিত্রে ভিন্নতা রয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে ৮৮ হাজার কোটি টাকা এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকলেও, কিছু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকে এখনো তারল্যের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো তারল্য ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।

এছাড়াও, সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে; জুনে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে সঞ্চয়পত্রের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকায়।

সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাত এখন এক দ্বৈত বাস্তবতার মুখোমুখি: অর্থ আছে কিন্তু চলাচল নেই, রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ বাড়ছে তবু বিনিয়োগে স্থবিরতা। তারল্য থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতির চাকা ধীর গতিতে ঘুরছে।


মন্তব্য