ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে ছিটকে পড়েছে ভারত!

ক্রেডিট কার্ড
  © ফাইল ছবি

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সব ধরণের সম্পর্কের প্রভাব পড়েছে। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশিদের জন্য ভিসাও সীমিত করে দেয় দেশটি। এছড়া আমদানি-রপ্তানিতেও বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর ফলে দেশটির সঙ্গে লেনদেনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বিদেশে ভ্রমণ, উচ্চশিক্ষা ও অনলাইন কেনাকাটাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও থাইল্যান্ড। এর বিপরীতে, প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই খাতে ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। একসময় বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড খরচের তালিকায় শীর্ষে ছিল ভারত, এখন সেই অবস্থান থেকে ছিটকে গিয়ে দেশটি ৭ নম্বরে নেমে এসেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর রয়েছে চীন, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া। পর্যটন, চিকিৎসা ও শিক্ষাসহ নানা কারণে এসব দেশে খরচের প্রবণতা বেড়েছে বলে জানা গেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈদেশিক ভ্রমণের বিধিনিষেধ এবং ভারতে চিকিৎসা ও কেনাকাটার পরিবর্তে অন্যান্য দেশের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় এই পরিবর্তন ঘটছে।

ক্রেডিট কার্ডে দেশে-বিদেশে লেনদেন সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের এপ্রিলের হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ৬২টি তফসিলি ব্যাংক ও ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে ৫৬টি তফসিলি ব্যাংক ও মাত্র ১টি এনবিএফআই গ্রাহকদের জন্য ক্রেডিট কার্ড সেবা প্রদান করে থাকে যাদের তথ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ দেশের ক্রেডিট কার্ডের প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

প্রতিবেদনে দেশের অভ্যন্তর ও বিদেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের এবং দেশের ভেতরে বিদেশি নাগরিকদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশিরা বিদেশে ভ্রমণ ও কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে কিছুটা সংযমী হয়ে উঠছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে বিদেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশিরা ৩৮৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ করেছেন। এই পরিমাণ আগের মাস এপ্রিলের তুলনায় ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ কম। এপ্রিলে খরচ ছিল ৪৬৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

চলতি বছরের মে মাসে ভারতে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড লেনদেন নেমে এসেছে মাত্র ২১ কোটি টাকায়, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭২ দশমিক ৫৫ শতাংশ কম। 

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের মে মাসে ভারতে এই খাতে ব্যয় ছিল ৭৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিশ্লেষকদের মতে, ভিসা জটিলতা, সীমান্ত পারাপারে কড়াকড়ি এবং অন্যান্য দেশের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়াই প্রতিবেশী দেশে কার্ডে খরচের প্রধান কারণ।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ডধারীদের লেনদেন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এসব দেশে উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা, প্রবাসী সংযোগ চাহিদা বাড়ার ফলে ক্রেডিট কার্ডে খরচও ক্রমেই বাড়ছে।

বর্তমানে বিদেশে ক্রেডিট কার্ডে বাংলাদেশিদের খরচের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মে মাসে দেশটিতে খরচ হয়েছে ৫৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা, এপ্রিলে খরচ ছিল ৬৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা, এর আগে মার্চে খরচ ছিল ৫৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং ফেব্রুয়ারিতে ৫২ কোটি ৩০ লাখ কোটি টাকা।

দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীনে খরচ হয়েছে ৪০ কোটি টাকা, তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে থাইল্যান্ড, সেখানে খরচ হয়েছে  ৩৫ কোটি টাকা। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্যে; মে মাসে দেশটিতে ৩৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা খরচ করেছে। সিঙ্গাপুরে খরচ ৩২ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং মালয়েশিয়ায় খরচ ২৪ কোটি টাকা।  

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতমুখী ভ্রমণ ও ব্যয়ের হার কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো দুই দেশের মধ্যে চলমান কূটনৈতিক টানাপড়েন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই ভারত বাংলাদেশিদের জন্য পর্যটক ভিসা প্রদান বন্ধ রেখেছে। কবে নাগাদ এই ভিসা চালু হবে, সে বিষয়ে এখনো ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস দেওয়া হয়নি।

শুধু ভিসা স্থগিত নয়, ভারত বাংলাদেশে কিছু পণ্য রপ্তানিও বন্ধ রেখেছে এবং ভারত হয়ে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ফলে যেসব বাংলাদেশি প্রতিবছর নিয়মিতভাবে কলকাতা, দিল্লি, দার্জিলিং, সিকিম কিংবা মেঘালয়ে ভ্রমণে যেতেন, তারা এখন সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

এই প্রেক্ষাপটে ভারতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্র, চীন, থাইল্যান্ড  মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে ভ্রমণ এবং ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

বিদেশে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার কমলেও, দেশের মধ্যে ব্যবহার বেড়েছে। এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বেড়েছে ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এপ্রিলে যেখানে লেনদেন ছিল ৩ হাজার ১৬ কোটি টাকা, মে’তে তা বেড়ে ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকায় উঠেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ভেতরে ১১টি খাতে সবচেয়ে বেশি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর,পরিষেবার বিল পরিশোধ, খুচরা কেনাকাটা, নগদ উত্তোলন, পোশাক কেনাকাটা, ওষুধ ও ফার্মেসি, অর্থ স্থানান্তর, পরিবহন খাতে ব্যয়, ব্যবসায়িক ও পেশাদারি সেবা এবং সরকারি সেবার বিল প্রদান। বেশিরভাগ খাতেই এপ্রিলে খরচ কমেছে।

এছাড়া, ৭৬ শতাংশ লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে ভিসা কার্ড ব্যবহার করে, ১৪ শতাংশ মাস্টারকার্ড এবং ১০ শতাংশ এমেক্স কার্ড ব্যবহার করা হয়েছে।


মন্তব্য