শুল্ক সফলতার নেপথ্যে যে কাহিনী

শুল্ক
  © ফাইল ছবি

গত তিন মাসের অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ, আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষি পর অবশেষে শুল্ক আলোচনায় সাফল্য পেল বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র গতকাল (১ আগস্ট) বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ থেকে শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীজনদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে ঢাকা একটি আকর্ষণীয় প্যাকেজ প্রস্তাব উপস্থাপন করলে তৃতীয় দফার ফলপ্রসূ আলোচনার পর এই সাফল্য আসে।

উপযুক্ত প্যাকেজ প্রস্তুত করে গত ২৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অবস্থানপত্র পাঠানোর পর থেকেই পরিস্থিতি বাংলাদেশের অনুকূলে যেতে শুরু করে। এর আগে পর্যন্ত ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তৃতীয় দফার বৈঠকের জন্য কোনো স্লট পাচ্ছিল না বাংলাদেশ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বারবার অনুরোধের পর শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ২৯ জুলাই আড়াই ঘণ্টার জন্য ভার্চুয়াল মিটিংয়ের স্লট দেয়। তবে বাংলাদেশের কাছ থেকে চূড়ান্ত অবস্থানপত্র পাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব বদলে যায়। এক দিনের ভার্চুয়াল মিটিংয়ের পরিবর্তে ইউএসটিআর তিন দিনের সশরীরে বৈঠকের স্লট নির্ধারণ করে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলকে আমন্ত্রণ জানায়।

দ্বিতীয় দফার আলোচনার পর বাংলাদেশের শুল্ক যখন ৩৭ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রায় একই সময়ে ভিয়েতনামের শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়, তখনই ঢাকা দরকষাকষির জন্য সিরিয়াস হয়ে ওঠে।

 চূড়ান্ত প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রথম দিনই ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মতামত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর দুদিন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও সচিবদের নিয়ে দীর্ঘ সভা করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কী কী পণ্য আমদানি করা যায়, তার তালিকা প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়।

একইসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বাংলাদেশে ব্যবসারত যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি শেভরন ও এক্সিলারেট এনার্জির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভাচুর্য়াল মিটিং করে শুল্ক কমানোর জন্য বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে কোম্পানিগুলোর মতামত নেন। এছাড়া ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল ও আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও ভার্চুয়াল বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা।

এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বছরে ৭ লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া বাজারদরের চেয়ে কিছুটা বাড়তি দামে দেশটি থেকে ২.২০ লাখ টন গম কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনা, স্পট মার্কেট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এলএনজি আমদানি করা, সরকারিভাবে তুলা আমদানি করে বাংলাদেশের ওয়্যারহাউজে রেখে বাংলাদেশের আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব অনুযায়ী মার্কিন পণ্য আমদানিতে শুল্কছাড় দেওয়ার প্রস্তাব চূড়ান্ত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অধিক পরিমাণ সয়াবিন ও তুলা আমদানির উদ্যোগও নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকারি প্রতিনিধিদল যখন ইউএসটিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা করেন, তখন বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদল সেখানকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে সয়াবিন ও তুলা আমদানির চুক্তি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডাল আমদানি বাড়ানোর প্রস্তাবও দিয়েছে বাংলাদেশ।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্যাকেজ প্রস্তাবে আরও কিছু আছে কি না, তা জানা যায়নি।  

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, 'বাণিজ্য উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন একটা প্যাকেজ নিয়ে—বোয়িং, গম, সয়াবিনসহ আরো কী কী কিনতে পারি, তা নিয়ে।'

পাল্টা শুল্ক থেকে রক্ষা পেতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক বিমান বা অন্য কোনো কেনাকাটার উদ্যোগ আছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, 'আরও আছে। কী কী আছে, সেটা এখন আমি বলব না। বাণিজ্য উপদেষ্টা ফিরে এলে তার পর বলব।'

চূড়ান্ত দফার আলোচনায় অংশ নিতে ঢাকা ছাড়ার আগে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার, পাল্টা শুল্ক আরোপ করে তারা সেটি কমাতে চায়। আর বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার। 

বাংলাদেশ দেড় বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানান তিনি। 

এসব কিছুই বাংলাদেশের শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে আনতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

চূড়ান্ত দফার আলোচনার সময় বেসরকারি খাতের চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল ১৩০ মিলিয়ন ডলারের সয়াবিন আমদানির চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এছাড়া বাংলাদেশি আমদানিকারকরা ৩০-৩৫ মিলিয়ন ডলারের মার্কিন তুলা আমদানির চুক্তি করেছেন। 

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মর্তুজা বলেন, যে ২৫টি বোয়িং বাংলাদেশ কিনতে চেয়েছে, সেগুলোর সরবরাহ পেতে ১০-১৫ বছর সময় লাগবে। তাই এসব বিমানের দাম বাবদ একসঙ্গে অনেক টাকা পরিশোধের দরকার হবে না।

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ও বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানের দরকষাকষির দক্ষতার প্রশংসা করেন তিনি। সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসও দক্ষতা দেখিয়েছে বলে জানান তিনি।


মন্তব্য