সেই 'ফ্লাইট এক্সপার্ট' গ্রাহকের দেড়শ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা
- বাংলাকন্ঠ রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১২:৪৫ AM , আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১০:২৭ AM

অবশেষে কমপক্ষে দেড়শ কোটি টাকা মেরে রাতের আঁধারে বিদেশে পালিয়ে গেছেন সেই বিখ্যাত 'নো ব্যাক' খ্যাত হজ্ব এজেন্সি মালিক, আটাবের বর্তমান কমিটির উপদেষ্টা এম এ রশিদ শাহ সম্রাটের ছেলের মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান দেশের অন্যতম জনপ্রিয় অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি ফ্লাইট এক্সপার্ট। মূলত বিজনেস টু বিজনেস (বিটুবি) এবং কাস্টমার টু বিজনেস (বিটুসি) পদ্ধতিতে ব্যবসা করা এজেন্ট ও গ্রাহকদের শতকোটি টাকার পাওনা না দিয়েই কোম্পানিটি বন্ধ করে এর মালিকেরা দেশ ছেড়ে কানাডায় চলে গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, গতকাল (শুক্রবার) রাত থেকে হঠাৎ করেই সম্পূর্ন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উদ্বেগে ফেলেছে এর কয়েক হাজার গ্রাহক ও পর্যটন এজেন্টদের। এ খবর জানাজানি হলে আজ শনিবার সকাল থেকে ফ্লাইট এক্সপার্টের ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপ বন্ধ পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর মতিঝিলস্থ সিটি সেন্টারে প্রতিষ্ঠানটির সামনে জড়ো হন কয়েকশ গ্রাহক। তারা জানান, কোম্পানিটি বন্ধ করে এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সালমান বিন রশিদ শাহ সাইম ও তাঁর বাবা মক্কা গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ রশিদ শাহ সম্রাট গোপনে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন।
গ্রাহকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ফ্লাইট এক্সপার্ট ও মক্কা গ্রুপের মালিক বা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। তাদের মোবাইল ফোনেও কল করে কোনো উত্তর মেলেনি।
দেশের বিভিন্ন পর্যটন এজেন্সি, বিটুবি এজেন্ট ও সাধারণ গ্রাহকেরা দাবি করছেন, ফ্লাইট এক্সপার্টের কাছে তাঁদের শতকোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে। অনেকে এরই মধ্যে টাকা পরিশোধ করেও টিকিট, হোটেল বুকিংসহ অন্যান্য সেবা পাননি। এছাড়া আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থা আইএটিএর কাছে বিশাল অঙ্কের অর্থ বকেয়া রেখেছে ফ্লাইট এক্সপার্ট।
বাংলাকন্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত ৩১ জুলাইয়ের পরে আইএটিএ'র বকেয়া বাবত কমপক্ষে ৫০ কোটি পরিশোধ না করায় সংস্থাটি ফ্লাইট এক্সপার্টের বিপরীতে কোনো টিকেট বুকিং করেনি। তবে ফ্লাইট এক্সপার্টের মার্কেটে যে টাকা বকেয়া ছিল এবং গ্রাহকদের কমিশন দিতো সেই টাকার সিংহভাগ হাজি...ও একটি দেশীয় এয়ারলাইন্স কোম্পানীর মালিকের পরিবারের এক ব্যাক্তির মালিকানাধীন সোমা ...নামীয় প্রতিষ্ঠান পেছন থেকে যোগান দিতো বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বেশ কিছুদিন টাকা পরিশোধ না করায় হাজি.... ও সোমা... নামীয় প্রতিষ্ঠান টিকিট সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় আইএটিএ তাদের সব রিজার্ভেশন বাদ করে দেয়। এ সুযোগে ফ্লাইট এক্সপার্ট এজেন্ট ও গ্রাহকদের কমপক্ষে দেড়শ কোটি মেরে কানাডায় পাড়ি জমান।
সূত্র জানায়, ওটিএ ফ্ল্যাটফর্ম ফ্লাইট এক্সপার্ট তাদের টিকেটগুলো মাইনাস ফিগারে বিক্রি করতো। অর্থ্যাৎ তারা এয়ারলাইন্স কিংবা এজেন্সি থেকে যে দাম কিনতো গ্রাহকদের কাছে তার চেয়ে কম দামে বিক্রি করতো। অথচ সরকারী নির্দেশ রয়েছে কোনো ওটিএ ফ্ল্যাটফর্ম মাইনাস ফিগারে টিকিট বিক্রি করতে পারবে না। কিন্তু দেশে প্রচলিত সবগুলো ওটিএ ফ্ল্যাটফর্মই সরকারের এ নির্দেশ অমান্য করে মাইনাসে টিকিট বিক্রি করছে।
বলা হচ্ছে, ওটিএ ফ্লাটফর্মগুলো মূলত গ্রাহকের থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার কিংবা অন্যত্র লগ্নি করছে। এর মধ্যে একটি দেশীয় এয়ারলাইন্স কোম্পানী এক্ষেত্রে বড় মাফিয়ার ভূমিকা পালন করছে। ওই এয়ারলাইন্সের মালিকের বিভিন্ন নামে কমপক্ষে ৫টি ওটিএ ফ্ল্যাটফর্ম এ কাজ করছে। এরমধ্যে উক্ত এয়ারলাইন্সের মালিকের ট্রিপ লাভার, ট্রাভেল চেম, ফার্স্টট্রিপ, টেকট্রিপ, তার নিকট আত্বীয় এক মহিলার মালিকাধীন টেকঅফ এ কাজে এগিয়ে রয়েছে।
এছাড়াও উক্ত এয়ারলাইন্স কোম্পানীটি সোনার অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত বলেও নাম প্রাকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এজেন্সি মালিক অভিযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগ, নিজের বিমান ব্যবসার আড়ালে প্রতিদিনই শত শত সোনার বার অবৈধভাবে দেশে ঢুকছে। কিন্তু তিনি এতটাই চালাক যে বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট সবাইকেই ম্যানেজ করে তিনি এ ব্যবসা করছেন।
এছাড়াও দেশে আরো বেশ কিছু ওটিএ ফ্ল্যাটফর্ম বর্তমানে এ ব্যবসার নামে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে গোজায়ান, শেয়ারট্রিপ, গোপ্লেইন ইত্যাদিও রয়েছে বলে সূত্র জানায়।
এদিক ফ্লাইট এক্সপার্টের লাপাত্তার খবরে শনিবার সকাল থেকেই শত শত গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করে বিক্ষোভ করেছেন। এসব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করা ফ্লাইট এক্সপার্ট দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি খাতে পরিচিত নাম হয়ে ওঠে। কোম্পানিটি বিমানের টিকিট বুকিং, হোটেল রিজারভেশন, ট্যুর প্যাকেজ, ভিসা সহায়তাসহ নানা সেবা দিত।
এদিকে ফ্লাইট এ্রক্সপার্টের মূল মালিক এম এ রশিদ শাহ সম্রাটের বিরুদ্ধে ওমরার নামে মানব পাচারের অভিযোগ বহু পুরানো। তার মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান মক্কা হজ্ব গ্রুপের বিরুদ্ধে ওমরার নামে 'নো ব্যাক প্যাকেজ' চুক্তিতে মানব পাচারের অভিযোগে সরকার শাস্তিমুলক ব্যবস্থাও নিয়েছিল। কিন্তু পুরানো অভ্যাস বদলিয়ে এবার সে এবং তার ছেলে সালমান বিন রশিদ শাহ সাইম গ্রাহকের কমপক্ষে দেড়শ কোটি টাকা মেরে লাপাত্তা হয়ে যান।
তার এমন কর্মকান্ডে একাধিক এজেন্সি মালিক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা বলছেন, মক্কা গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ রশিদ শাহ সম্রাট এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ'র (আটাব) বর্তমান কমিটির উপদেষ্টা। মূলত আটাবের সভাপতি ও মহাসচিবের পরোক্ষ ইন্ধনেই সে এমন জালিয়াতির কাজ করেছে। কারণ, গত এক বছরে সাধারণ সদস্যরা ওটিএ'র কার্যক্রমে লাগাম টানতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করে আটাবের পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানালেও কমিটি কিছুই করেনি। তারা উল্টাে ওটিএ'কে রক্ষা করার জন্য যেন মরিয়া।
এ ব্যাপারে আটাবের সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফের সঙ্গে যোগােযাগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তার মোবাইলে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এর আগে হালট্রিপ এবং টিকেটিটোয়েন্টিফোরডটকমের মতো অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সিও গ্রাহকের অর্থ নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটলেও পর্যাপ্ত নজরদারি বা নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা না থাকায় বিপদে পড়ছে সাধারণ মানুষ।