বিশ্বব্যাংকের লাল তালিকায় বাংলাদেশ

বিশ্বব্যাংক
  © ফাইল ছবি

এখনো বিশ্বব্যাংকের লাল তালিকায় অবস্থান করছে বাংলাদেশ। মূলত খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির সূচকে সংস্থাটির লাল তালিকায় রয়েছে লাল-সবুজের দেশ। ২০২১ সালের জুন থেকে গত জুলাই পর্যন্ত অর্থাৎ সোয়া ৪ বছর ধরে বাংলাদেশ লাল তালিকায় অবস্থান করছে।

আলোচ্য সময়ে প্রতি মাসে বাংলাদেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশের উপরে। একই সময়ে প্রতি মাসে গড়ে খাদ্যপণ্যের দাম সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। পণ্যভেদে দাম আরও বেশি বেড়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির সূচকে ৫ শতাংশের নিচে নামলেই লাল বা ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা থেকে বের হতে পারবে বাংলাদেশ।

এর আগে সর্বশেষ ২০২১ সালের মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশের কম বেড়েছিল অর্থাৎ ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এরপর থেকে এ হার ৫ শতাংশের উপরে রয়েছে। বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের এমন চিত্র পাওয়া গেছে। 

বাংলাদেশ গত সোয়া ৪ বছরের বেশি সময় ধরে এই লাল বা ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় অবস্থান করছে। গত রোজার সময় থেকে জুন পর্যন্ত অনেক পণ্যের দাম কমলেও সাম্প্রতিক সময়ে আবার বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য চাল, সবজি, ডিম, মুরগিরর দাম বাড়ছে। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে লাল তালিকা থেকে সহসা বের হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যেসব দেশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে লাল ও পিঙ্গেল বর্ণের (কালচে লাল বা তামাটে রং) তালিকায় থাকবে ওইসব দেশের মুদ্রার মান স্থিতিশীল নয় বলে ধরে নেওয়া হয়। ফলে ওইসব দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের আগে অর্থনৈতিক সূচকগুলোর ক্ষেত্রে ডলারের প্রবাহ, দাম ও মূল্যস্ফীতির হার সবার আগে পর্যালোচনা করে।

বিশ্বব্যাংক খাদ্য মূল্যস্ফীতির সূচক তৈরির ক্ষেত্রে কিছু ধাপ অনুসরণ করে। এর মধ্যে যেসব দেশের খাদ্যপণ্যের দাম প্রতি মাসে গড়ে ২ শতাংশের কম বাড়ে ওইসব দেশকে সবুজ তালিকায় রাখে। অর্থাৎ কোনো ঝুঁকি নেই। যেসব দেশের খাদ্যপণ্যের দাম প্রতি মাসে ২ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে বাড়ে ওইসব দেশকে হলুদ তালিকায় রাখে। অর্থাৎ দেশটি ঝুঁকির দিকে চলে যাচ্ছে। এখনই খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যেসব দেশের খাদ্যপণ্যের দাম প্রতি মাসে ৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে বৃদ্ধি পায় তাদের রাখে লাল তালিকায়। ওইসব দেশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে গেছে।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেমন সবুজ তালিকায় ছিল, তেমনি হলুদ তালিকায়ও ছিল। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে খাদ্যপণ্যের দাম সর্বনিম্ন দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়ে সবুজ তালিকায় স্থান পেয়েছিল। ২০১১-১২ অর্থবছরে ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ বেড়ে হলুদ তালিকায় ছিল। অন্য সময়গুলোতে ৫ শতাংশের বেশি বেড়ে লাল তালিকায় ওঠেছে। 

প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, অনেক দেশ বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে লাল তালিকা থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারেনি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও ২০২২ সালে শুরু বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতি খুবই ধীর। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যে কারণে মূল্যস্ফীতির হার যেমন খুবই ধীর গতিতে কমছে, একই গতিতে কমছে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারও। জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশে। এদিকে এখনো দেশে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের মূল্য বাড়ছে ৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত।

সর্বশেষ যেসব দেশে খাদ্যপণ্যের দাম প্রতি মাসে গড়ে ৩০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ওইসব দেশকে পিঙ্গল বর্ণের তালিকায় ফেলা হয়েছে। ওই তালিকাকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি নিরূপণের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশকে পিঙ্গল বর্ণ দিয়ে শনাক্ত করা হয়। এক সময় বাংলাদেশও মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে পিঙ্গল বর্ণ অর্থাৎ অতি ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ছিল। পরে ওই তালিকা থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ এখন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ঝুঁকিমুক্ত দেশের তালিকায় আছে। যে দেশ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকবে ওই দেশকে বৈদেশিক বাণিজ্য করতে গেলে বাড়তি কমিশন দিতে হয়, বৈদেশিক ঋণ নিতে গেলেও বাড়তি গ্যারান্টি ফি দিতে হয়। এতে ব্যবসা খরচ বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১৪ দশমকি ১০ শতাংশে উঠেছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা আবার ৫ শতাংশের নিচে অর্থাৎ ৪ দশমিক ২৩ শতাংশে নেমেছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। এরপর ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ শতাংশের ঘরেই ছিল খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ হার আবার বেড়ে সাড়ে ৬ শতাংশে ওঠে। ওই সময়ে করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকা ব্যাপক হারে বাজারে ছাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছিল। পরের ২০২০-২১ অর্থবছরে আবার তা কমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশে। ওই অর্থবছরের মে মাসে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির হার কমে ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশে দাঁড়ায়। যদিও বছরের হিসাবে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশের উপরে ছিল। এরপর থেকে তা ঊর্ধ্বমুখী হয়। 

করোনার পর মূল্যস্ফীতির হারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ হার বেড়ে ৬ দশমিক ২২ শতাংশে ওঠে। এর আগে এ হার গড়ে ৫ শতাংশের ঘরেই ছিল। ওই মাসের শেষ দিকে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করলে বৈশ্বিকভাবে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। দেখা দেয় বৈশ্বিক মন্দা। এর নেতিবাচক প্রভাব অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পড়ে। ফলে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতির হার। মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৩০ শতাংশে ওঠে। এরপর থেকে এ হার বাড়তেই থাকে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে এ হার বেড়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে ওঠে। যা ছিল ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির সমান। এরপর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার টাকা ছাপানো বন্ধ করে। ডলারের দাম স্থিতিশীল করে। পণ্যমূল্য কমাতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। ফলে সার্বিক মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারও কমতে থাকে।


মন্তব্য