বিমা খাতে সংকট
- বাংলাকন্ঠ রিপোর্ট:
- প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৫, ১২:২৬ PM , আপডেট: ২০ আগস্ট ২০২৫, ১২:২৬ PM

ভরসার জায়গা হওয়ার কথা থাকলেও বিমা খাত এখনো বহু গ্রাহকের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। এর পেছনে রয়েছে বাস্তব কারণ। দেশের ৪৬টি নন-লাইফ বিমা কোম্পানি গ্রাহকের দাবির প্রায় ৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা আটকে রেখেছে। যেখানে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এ অঙ্ক ছিল ২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা, সেখানে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে আরও ৫১৫ কোটি টাকা যোগ হয়ে অনিষ্পন্ন দাবির বোঝা আরও বেড়েছে।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সর্বশেষ অনিরীক্ষিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সাধারণ বিমায় দাবি দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪৪৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর বিপরীতে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৯৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকার বিপরীতে গ্রাহকের হাতে ফিরেছে সাড়ে আট টাকারও কম, বাকি প্রায় ৯১ টাকা এখনো বকেয়া। এই চিত্র খাতটির আস্থা সংকটের স্পষ্ট প্রমাণ।
গ্রাহক পর্যায়ের অভিযোগও একই ছবি তুলে ধরে। নানা কাগজপত্রের জটিলতা, সার্ভে রিপোর্ট, পুনর্বিমার অজুহাত আর ধাপেধাপে ঘুরতে ঘুরতে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন; কিন্তু দাবির টাকা পান না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দাবি পরিশোধে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে সিকদার ইনস্যুরেন্স। কোম্পানিটি ২৭ কোটি ১৩ লাখ টাকার বিপরীতে দিয়েছে মাত্র ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা—যা ৯৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ বকেয়া। দ্বিতীয় অবস্থানে সেনা কল্যাণ ইনস্যুরেন্স, ৪৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকার বিপরীতে দিয়েছে মাত্র ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, পরিশোধের হার শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে থাকা নর্দান ইসলামী ইনস্যুরেন্স ৬৪ কোটি ৫২ লাখ টাকার মধ্যে দিয়েছে ৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা—পরিশোধের হার ১ দশমিক ০৬ শতাংশ।
অন্যদিকে স্ট্যান্ডার্ড ইনস্যুরেন্স ও ঢাকা ইনস্যুরেন্স যথাক্রমে ১ দশমিক ৪৪ ও ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ দাবি নিষ্পত্তি করেছে। অর্থাৎ দুটি কোম্পানিরও প্রায় ৯৯ শতাংশ দাবি এখনো গ্রাহকের কাছে বকেয়া রয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, অধিকাংশ কোম্পানি গ্রাহকদের দাবি নগণ্য হারে পরিশোধ করেছে। পিপল ইনস্যুরেন্স দিয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৮২ শতাংশ, ইস্টার্ন ৩ দশমিক ১৬, দেশ জেনারেল ৩ দশমিক ৪৪, এসবিসি ৩ দশমিক ৭৯, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ ৪ দশমিক ০১ এবং এশিয়া প্যাসিফিক ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। তুলনামূলক কিছুটা বেশি পরিশোধ করেছে পূরবী জেনারেল ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ, সাউথ এশিয়া ৭ দশমিক ৮০ এবং প্যারামাউন্ট ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় রয়েছে ফনিক্স ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ, গ্রিন ডেলটা ৯ দশমিক ৪৭ ও মার্কেন্টাইল ইসলামী ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
আইডিআরএর চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম বলেন, দাবি নিষ্পত্তি না হওয়া এই খাতের প্রধান সমস্যা। মূলত এই কারণে পরিস্থিতি একটি ক্রান্তিকাল পেরোচ্ছে। তাঁর ভাষ্য, ‘সমস্যা শনাক্ত হয়েছে, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ বাস্তবতা হচ্ছে, বিমার বাজারে যে আস্থার ক্ষয় তৈরি হয়েছে, সেটি শুধু আশ্বাসে পূরণ হয় না; এখানে দ্রুত ও দৃশ্যমান ফল দেখতে চায় সবাই।
অন্যদিকে বিপরীত প্রান্তে জনতা ইনস্যুরেন্স দাবি নিষ্পত্তিতে সেরা, তারপর ইউনিয়ন ইনস্যুরেন্স, প্রাইম ইনস্যুরেন্স। এসব প্রতিষ্ঠান প্রমাণ করছে, ইচ্ছা ও প্রক্রিয়া থাকলে অর্থ ছাড় সম্ভব। অর্থাৎ সেক্টরের জট শুধু টাকার ঘাটতি নয়; বরং শাসনব্যবস্থা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং দায়বদ্ধতার ঘাটতিও সমান দায়ী।
তবে এ বিষয়ে কোম্পানিগুলোর ব্যাখ্যা বরাবর পুরোনো। জানতে চাইলে সিকদার ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রফিক বলেন, ‘৫ আগস্টের কয়েকটি দুর্ঘটনার দাবি সাধারণ বিমা করপোরেশনে পড়ে রয়েছে। এসবিসি থেকে অর্থ পেলে দেওয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এই বক্তব্য বাজারের কাঠামোগত দুর্বলতাকে তুলে ধরে। তাঁদের প্রশ্ন, রি-ইনস্যুরেন্স বা পুনর্বিমার ধারায় সমন্বয়ে ব্যর্থ হলে প্রাইমারি গ্রাহক কেন আটকে থাকবেন? তাঁরা মনে করেন, এই দায় এড়ানো যায় না।