দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ঋণ তিন মাসে
- বাংলাকন্ঠ রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:২৩ PM , আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:২৩ PM

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলা ডলার সংকট সামাল দিতে শেখ হাসিনার সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বিদেশি ঋণ বাড়ানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পতন থামানো যায়নি। এ অবস্থায় গত তিন মাসে বিদেশ থেকে বাংলাদেশের ঋণের স্থিতি বেড়ে ১১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
জানা গেছে, বিদেশ থেকে বাংলাদেশের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন—এ তিন মাসে বিদেশি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার, যার প্রায় সবটাই সরকারি খাতে।
মূলত উক্ত তিন মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা, এআইআইবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে এ ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ।
সূত্র জানায়, বিগত সরকারের আমলে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বিদেশি ঋণ বাড়ানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পতন থামানো যায়নি। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে রিজার্ভের পতন থামাতে সক্ষম হয়েছে। ডলারের বিনিময় হারেও এসেছে স্থিতিশীলতা। প্রবাসী আয়ে জোরালো প্রবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক উৎস্য থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণ পাওয়াই এর অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলারের বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আসায় এখন বিদেশি ঋণ গ্রহণের ঝুঁকি কমে এসেছে। তবে উদ্বেগের জায়গা হলো, ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে পরিশোধের ক্ষেত্রে চাপ তৈরি হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারের ঋণই বেশি। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের বিদেশি ঋণ দরকার আছে। তবে উদ্বেগের জায়গা হলো, আগে বিদেশি ঋণ নিয়ে অপচয় হয়েছে। সেগুলো যদি বন্ধ না হয়, তাহলে ঋণ বৃথা হয়ে যায়। আর যদি ঋণ নিয়ে ঠিকমতো ব্যবহার করা যায়, তাহলে পরিশোধ করার সক্ষমতা তৈরি হবে।
তিনি আরও বলেন, জিডিপি অনুপাতে বিদেশি ঋণ এখনো সহনীয় মাত্রায় আছে। যদিও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তুলনায় বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল পরিশোধের অঙ্কটা অনেক বেড়ে গেছে। ফলে সার্বিকভাবে স্বস্তিদায়ক মনে হলেও পরিশোধ করতে গিয়ে ঠিকই ঘাম বেরিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুন শেষে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ২১৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ১১২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। গত মার্চ পর্যন্ত আগের তিন মাসে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১০৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ জুন পর্যন্ত তিন মাসে বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৭ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন বা ৭০২ কোটি ডলার। আর গত বছরের ডিসেম্বরে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১০৩ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার। তবে ২০২৪ সালের শেষ তিন মাসে বিদেশি ঋণ কমেছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১০৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার, যা ওই বছরের ডিসেম্বরে কমে হয় ১০৩ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত জুন শেষে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। এর তিন মাস আগে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৮৪ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ তিন মাসে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে গত জুন শেষে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের স্থিতি কমে হয় ১৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। তিন মাস আগে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১৯ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ তিন মাস বেসরকারি খাতে ঋণের স্থিতি কমেছে দশমিক ১১ বিলিয়ন বা ১১ কোটি ডলার। যদিও এ সময়ে বেসরকারি খাতে ৭ কোটি ডলারের বেশি স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছে, তবে বাণিজ্যিক ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধ হয়েছে বেশি। ফলে স্থিতি কমেছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, দেশি উৎসের চেয়ে বিদেশি ঋণের সুদের হার এখন তুলনামূলক কম। ফলে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাও এখন বিদেশ থেকে ঋণে ঝুঁকছেন। তবে ঢালাওভাবে সবাই যাতে এ ঋণ নিতে না পারে, সে বিষয়ে এখনই সতর্ক হওয়া দরকার। বিশেষ করে যাদের বৈদেশিক মুদ্রায় আয় নেই, তাদের বিদেশি ঋণ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে না।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার বিদায় নেওয়ার পর (২০০৬ সাল শেষে) বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে তা সোয়া দুই বিলিয়ন ডলারের মতো বাড়ে। এতে ২০০৮ সাল শেষে স্থিতি দাঁড়ায় ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। তবে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে তা ৮২ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ১০৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।