হাসিনার বিচার ইস্যুতে সরব বিশ্ব মিডিয়া
- বাংলাকন্ঠ রিপোর্ট:
- প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৫, ০১:৩২ PM , আপডেট: ০২ জুন ২০২৫, ০২:২৫ PM

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)-তে জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কার বিক্ষোভের সময় গণহত্যা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে । আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের সময় তিনি হত্যাকাণ্ড উস্কে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে আগস্টের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী দমন-পীড়ন চালিয়ে গণহত্যা করেছে ১৪০০ মানুষকে। এরপর ছাত্রদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী বিক্ষোভ গণআন্দোলনে রূপ নিলে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের ইতি টেনে ৭৭ বছর বয়সী স্বৈরশাসক ভারতে পালিয়ে যান। পলাতক প্রধানমন্ত্রীর বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিশ্ব মিডিয়া এমনই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি লিখেছে, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে যুক্ত সাবেক বেশ কিছু সিনিয়র নেতা, বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সঙ্গে কিছু নেতার বিরুদ্ধে বিচার হচ্ছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিটি)। সূচনা বক্তব্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বিষয়ে রোববার আইসিটির প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, তথ্যপ্রমাণ যাচাই শেষে আমরা এই উপসংহারে পৌঁছেছি যে, এটা ছিল সমন্বয়ের মাধ্যমে, ব্যাপকভাবে এবং পর্যায়ক্রমিক হামলা। অভিযুক্তরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এবং তার দলের সশস্ত্র সদস্যদের ব্যবহার করেছে গণআন্দোলন দমিয়ে দিতে। শেখ হাসিনা ও তার দু’জন কর্মকর্তার প্রতিজনের বিরুদ্ধে ৫টি করে অভিযোগ করেন তাজুল ইসলাম। এর মধ্যে আছে জুলাই বিদ্রোহের সময় গণহত্যায় প্ররোচনা দেয়া হয়েছে, উস্কানি দেয়া হয়েছে, সহযোগিতা দেয়া হয়েছে, ষড়যন্ত্র করা হয়েছে এবং গণহত্যা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
প্রসিকিউটররা বলেন, এসব কর্মকর্তা মানবতা বিরোধী অপরাধী হিসেবে ধর্তব্য। রিপোর্টে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনা এখনও ভারতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছেন। তিনি এসব অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। শেখ হাসিনা ছাড়াও এই মামলার আসামিদের মধ্যে আছেন সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এর মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুন নিরাপত্তা হেফাজতে আছেন। তবে রোববার তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি। অন্যদিকে আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক আছেন।
রিপোর্টে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনার সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তাদের বিচার এখন ক্ষমতার লড়াইরত বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মূল দাবিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগামী নির্বাচন দিতে চেয়েছে ২০২৬ সালের জুনের আগেই। ওদিকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম রোববার সরাসরি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বাংলাদেশ টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করে। এটাই বাংলাদেশে কোনো বিচারিক কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচারের ঘটনা। প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম প্রতিশ্রুতি দেন যে, বিচার হবে পক্ষপাতিত্বহীন।
তিনি বলেন, এটা প্রতিশোধ নেয়ার কোনো ঘটনা নয়। তবে নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের কোনো স্থান নেই।
এএফপি আরও লিখেছে, তদন্তকারীরা মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত ভিডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিপ সংগ্রহ করেছেন। সংগ্রহ করেছেন শেখ হাসিনার ফোনের কথোপকথন, হেলিকপ্টারের রেকর্ড এবং ড্রোন উড়ানোর ঘটনা। একই সঙ্গে দমন-পীড়নের শিকার ভিকটিমদের বক্তব্যও সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রসিকিউশন যুক্তি উপস্থাপন করে যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের মাধ্যমে প্রতিবাদকারীদের দমন (ক্র্যাশ) করার জন্য নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
তাজুল ইসলাম বলেন, এর ফলে তারা পর্যায়ক্রমিকভাবে হত্যাকাণ্ড, অ্যাটেম্পটেড মার্ডার, নির্যাতন ও অন্য অমানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। প্রকিসিউটররা আরও অভিযোগ করেন যে, শেখ হাসিনার নির্দেশের পর নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা হেলিকপ্টার থেকে (বিক্ষোভকারীদের ওপর) প্রকাশ্যে গুলি করেছে। রংপুরের প্রতিবাদী ছাত্র আবু সাঈদকে হত্যায় নির্দেশ দেয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করেছেন তারা।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ১৬ই জুলাই রংপুরে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয় আবু সাঈদকে। ওই প্রতিবাদ বিক্ষোভে পুলিশের দমন-পীড়নে প্রথম নিহত ছাত্রনেতা তিনি। হাসিনার পতনের পর তাকে হত্যার শেষ মুহূর্তকে বার বার বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলো দেখিয়েছে।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে যুক্ত এই মামলার প্রথম বিচারিক কার্যক্রম আইসিটি শুরু করে ২৫শে মে। মামলায় ৫ই আগস্ট কমপক্ষে ৬ জন প্রতিবাদীকে হত্যার জন্য মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য পুলিশের আট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই ৫ই আগস্ট হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এর মধ্যে চারজন কর্মকর্তা হেফাজতে রয়েছেন। বাকি চারজনের বিচার শুরু হয়েছে তাদের অনুপস্থিতিতে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তাকারীদের বিচার করতে ২০০৯ সালে আইসিটি গঠন করেন শেখ হাসিনা। এই আদালত হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বেশ কয়েকজন প্রথম সারির নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। সেই বিচারকে ব্যাপকভাবে দেখা হয়, শেখ হাসিনার প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার উদ্দেশ্য হিসেবে। ওদিকে আলাদাভাবে রোববার সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। এর অর্থ তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। এর আগে শেখ হাসিনা জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং এ দলটির নেতাদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালিয়েছিলেন। অন্যদিকে মে মাসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগকে।
ভারতের অনলাইন ক্রল লিখেছে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ গঠন করেছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে হত্যার (মাস কিলিং) অভিযোগ আনা হয়েছে। আল জাজিরা তার রিপোর্টে বলেছে, আদালতের সামনে অভিযোগ তুলে ধরেন প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি ছাত্রদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকারের সহিংসতাকে সমন্বয়ের মাধ্যমে, বিস্তৃতভাবে এবং পর্যায়ক্রমিক হামলা বলে অভিহিত করেছেন।
বলা হয়েছে, অভিযুক্তরা আন্দোলন গুঁড়িয়ে দিতে সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, শেখ হাসিনার দলের সশস্ত্র সদস্যদের ব্যবহার করেছেন। ওদিকে জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১লা জুলাই থেকে ১৫ই আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশে হত্যা করা হয়েছে ১৪০০ মানুষকে। এর বেশির ভাগই নিহত হয়েছেন বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের গুলিতে। নিহতদের শতকরা ১২ থেকে ১৩ ভাগই শিশু।