রয়টার্সের প্রতিবেদন
হরমুজ প্রণালি নিয়ে ইরানের যে কৌশলে শঙ্কিত হয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র
- আর্ন্তজাতিক ডেস্ক
- প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫, ০২:১৮ PM , আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৫, ০২:১৮ PM

গত মাসে ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যে ইরান পারস্য উপসাগরের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হরমুজ প্রণালিতে জল-মাইন স্থাপনের প্রস্তুতি নেয়। দুই মার্কিন কর্মকর্তার বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরায়েল ইরানে হামলা চালানোর পর তেহরান প্রণালি অবরোধের পরিকল্পনা করছিল। বিষয়টি নিয়ে ওয়াশিংটন শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল।
গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ১৩ জুন ইরানে প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর কয়েক দিন পর ইরান সেনাবাহিনী জল-মাইন বোঝাই নৌযান হরমুজ প্রণালির দিকে পাঠায়। যদিও এখন পর্যন্ত ওই মাইনগুলো প্রণালিতে মোতায়েন করা হয়নি। ঘটনাটি এত দিন গোপন রাখা হয়েছিল।
বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক নৌপথগুলোর একটি হরমুজ প্রণালি। ইরান যদি এটি বন্ধ করে দিলে বৈশ্বিক বাণিজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে এবং চলমান উত্তেজনা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বের মোট তেল-গ্যাস রপ্তানির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এই প্রণালি দিয়ে যায়। এটি বন্ধ হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম আকাশচুম্বী হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তবে এখন পর্যন্ত বাস্তবে তা ঘটেনি। বরং, যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পর থেকে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ১০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। বড় ধরনের কোনো অস্থিতিশীলতা হয়নি বাজারে।
গত ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর ইরানের পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়ে প্রস্তাব অনুমোদন করে। তবে সেটি বাধ্যতামূলক ছিল না। ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ওপর ছিল চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভার। ইরান আগে বহুবার এই প্রণালি বন্ধের হুমকি দিলেও কখনো সেটি বাস্তবায়ন করেনি।
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ চলাকালে ঠিক কখন তেহরান জল-মাইন মোতায়েনের জন্য জাহাজে তুলেছিল, তা নির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। এ ছাড়া, মাইনগুলো এখন জাহাজ থেকে নামানো হয়েছে কি না, তাও স্পষ্ট নয়।
যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এই তথ্য জানতে পারল—সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেননি মার্কিন কর্মকর্তারা। তবে সাধারণত স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি কিংবা গোপন সূত্রের মাধ্যমে এমন তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।
হরমুজ প্রণালি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জানতে চাইলে হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের (ডোনাল্ড ট্রাম্প) দক্ষ নেতৃত্বে পরিচালিত অপারেশন মিডনাইট হ্যামার, হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান এবং সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের কারণেই হরমুজ প্রণালি খোলা আছে। নৌ-চলাচলের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ইরান এখন অনেকটাই দুর্বল।’
এ বিষয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর বা ইরানের জাতিসংঘ মিশনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। দুই মার্কিন কর্মকর্তা জানান, মাইন মোতায়েনের জন্য জাহাজে তোলার এই পদক্ষেপ আসলে ইরানের কৌশলগত চালও হতে পারে। তারা হয়তো দেখাতে চেয়েছে, হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়ে তারা সত্যিই প্রস্তুত। আবার তারা এমন প্রস্তুতি নিয়েছে, যাতে প্রয়োজন হলে তা বাস্তবায়ন করা যায়।
হরমুজ প্রণালি ওমান ও ইরানের মাঝখানে। এটি পারস্য উপসাগরকে দক্ষিণে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। সবচেয়ে সংকীর্ণ স্থানে প্রণালির প্রস্থ ২১ মাইল (৩৪ কিলোমিটার)। এর মধ্যে ২ মাইল করে নৌ-চলাচলের পথ রয়েছে।
ওপেকভুক্ত—সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও ইরাক তাদের অধিকাংশ তেল এই পথ দিয়ে এশিয়ায় রপ্তানি করে। বিশ্বের অন্যতম বড় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানিকারক কাতারও প্রায় সম্পূর্ণ রপ্তানি এই পথ দিয়ে করে। ইরান নিজেও তাদের অধিকাংশ তেল এই প্রণালি দিয়ে রপ্তানি করে। তাই সাধারণভাবে তাদের এই পথ বন্ধ করার ইচ্ছা কম। তবে তারা বরাবরই এই পথ বন্ধ করার সামরিক সক্ষমতা ধরে রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির ২০১৯ সালের হিসাব অনুসারে, ইরানের কাছে ৫ হাজারের বেশি জল-মাইন আছে। দ্রুতগামী ছোট নৌকা দিয়ে সেগুলো খুব সহজেই মোতায়েন করা যায়।
আরব সাগর অঞ্চলে বাণিজ্য নিরাপত্তা রক্ষায় বাহরাইনে অবস্থান করে যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর। সাধারণত সেখানে ৪টি মাইন-নিষ্ক্রিয়কারী (এমসিএম) জাহাজ থাকত। এখন এগুলোর পরিবর্তে আরও আধুনিক ‘লিটারাল কমব্যাট শিপ’ বা এলসিএস মোতায়েন করা হচ্ছে, যেগুলোতেও মাইন প্রতিরোধের প্রযুক্তি রয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলার আগে সম্ভাব্য পাল্টা আঘাতের আশঙ্কায় বাহরাইন থেকে সব মাইন-নিষ্ক্রিয়কারী জাহাজ সরিয়ে নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ইরান শুধু কাতারে অবস্থিত একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইরানের পক্ষ থেকে আরও পাল্টা হামলার সম্ভাবনা তারা উড়িয়ে দিচ্ছেন না।