ইসলামী ব্যাংকে আতঙ্ক

এস আলম
  © ফাইল ছবি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির বিশেষ যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর)। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টাব্যাপী এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে রাজধানীর তিনটি কেন্দ্রে। আলোচিত ও সমালোচিত এই পরীক্ষায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কর্মকর্তা অংশ নেবেন বলে জানা গেছে। যদিও একদল কর্মকর্তা পরীক্ষাটি বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ইসলামী ব্যাংকের বিশেষ যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়ায় কোনো বাধা নেই।

তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ সময় এস আলমের প্রভাবে অনেককে কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি তাদের জন্যই এই বিশেষ পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

১০০ নম্বরের লিখিত ও এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ)। অন্তত ৫০ শতাংশ নম্বর অর্জন করলে প্রার্থীরা উত্তীর্ণ হবেন। ব্যাংকটির প্রায় ৫ শতাধিক সিনিয়র ও প্রবেশনারি অফিসারসহ প্রায় ৫ হাজার জুনিয়র অফিসার এবং ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার এই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন।

মূলত ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ প্রথমে পরীক্ষার তারিখ ২৯ আগস্ট নির্ধারণ করেছিল। পরে ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার মো. হানিফ ২৭ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করলে আদালত বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। এদিকে গত বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি দিয়ে জানায়, বিশেষ যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষা নেয়া না নেয়া ইসলামী ব্যাংকের নিজস্ব এখতিয়ার। এ সিদ্ধান্তে পরীক্ষা আয়োজনের পথে কোনো বাধা নেই।

হাইকোর্টের নির্দেশনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, একটি বেসরকারি মালিকানাধীন লাভজনক প্রতিষ্ঠান বিধায় এর কর্মকর্তা/কর্মচারীদের চাকরি দেশের প্রচলিত আইন, বিধি-বিধান ও নিয়োগের শর্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেহেতু চাকরি এবং কর্মকর্তা/কর্মচারীদের কর্মদক্ষতার সঙ্গে ব্যাংকের লাভ-লোকসান বহুলাংশে জড়িত সেহেতু ব্যাংক স্বাধীনভাবে দেশের আইন ও বিধি-বিধান মেনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এতদূপ্রেক্ষিতে, বিশেষ যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষা গ্রহণ এবং চাকরিতে কাউকে রাখা বা না রাখার বিষয় ব্যাংকের নিজস্ব এখতিয়ারভুক্ত।

এদিকে ‘বিশেষ দক্ষতা মূল্যায়ন’ পরীক্ষার নামে চট্টগ্রামের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কর্মীকে ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা চলছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ইসলামী ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা। এ পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে গতকাল শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম নগরের জামালখান এলাকায় মানববন্ধন করেছেন তারা। এতে চট্টগ্রাম ছাড়াও বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে আসা কর্মকর্তারা অংশ নেন।

মানববন্ধনে তারা বলেন, পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকলে চাকরি থাকবে না এবং ক্যারিয়ারে উন্নতির সুযোগ থাকবে না—এমন নোটিশ দিয়ে ভয়ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে অংশ নেওয়া ব্যাংক কর্মকর্তা এস এম এমদাদ হোসাইন জানান, এই উদ্যোগটি মূলত চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে নেওয়া হয়েছে, যেখানে একই ব্যাচের অন্য অঞ্চলের কর্মকর্তাদের পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে না। তিনি বলেন, পাঁচ থেকে সাত বছর চাকরি করার পর হঠাৎ এমন পরীক্ষা নেওয়া সম্পূর্ণ অনৈতিক।

পরে রাতে পর ব্যাংকের ফেসবুক পেজে সব কর্মকর্তাকে যথাসময়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে ২৭ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করলে আদালত বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেন। সে প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বিশেষ যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষা নেয়া ইসলামী ব্যাংকের নিজস্ব এখতিয়ার। এ সিদ্ধান্তে পরীক্ষা আয়োজনে আর কোনো বাধা থাকল না। উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তাকে যথাসময়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে নির্দেশনা প্রদান করা যাচ্ছে।

এদিকে, পরীক্ষায় বসতে যাওয়া এসব কর্মকর্তারা রয়েছেন ছাঁটাই আতঙ্কে। তারা বলছেন, ব্যাংকটির অর্থনৈতিক সংকট নিরসনের পাশাপাশি এস আলমের আমলে নিয়োগ দেওয়া অযোগ্যদের বাদ দিতে এই পরীক্ষার আয়োজন করতে যাচ্ছে ইসলামী ব্যাংক। তবে চাকরিরত এসব কর্মকর্তা পড়ছেন উভয় সংকটে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা যারা চাকরিরত আছি তাদের অধিকাংশের চাকরিকাল ৫-৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। এতদিন পর এসে এখন নেই কোনো পরীক্ষার প্রস্তুতি, আবার ছাঁটাই করলে অন্যকোনো চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বয়সও শেষ। শুধু তাই নয়, আমরা এখন পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বোঝা হয়ে দাঁড়াবো।

তবে ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এস আলম গ্রুপের সময় নিয়োগ পাওয়াদের মূল্যায়ন পরীক্ষা নিয়ে সরাসরি কোনো কথা বলেনি। তারা বলছে, এখানে কর্মরতদের চাকরিতে কাউকে রাখা বা না রাখার বিষয় ব্যাংকের নিজস্ব এখতিয়ারভুক্ত। বিশেষ যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়াও ব্যাংকের নিজস্ব এখতিয়ারভুক্ত।

জানা গেছে, ২০১৬ সালে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ট সহচর এস আলম গ্রুপ। তারা ২০১৭ সালে ৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় অবৈধভাবে ব্যাংক দখল করে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের কোনো শেয়ার ছিল না। টানা ৩৪ বছর জামায়াত ইসলামীর করায়ত্তে থাকার পর ওই সময়ে পুরোপুরি বদলে যায় ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। 

নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ইসলামী ব্যাংকের নিজস্ব নির্দিষ্ট সার্কুলার, লিখিত পরীক্ষা, ভাইভা ছাড়াই প্রায় ৯ হাজার কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এসব কর্মকর্তার বেশির ভাগই গ্রুপটির মালিক সাইফুল আলমের নিজের পটিয়া উপজেলার। ২০১৬ সালে ব্যাংকে কর্মকর্তা ছিল ১৩ হাজার ৫৩৯ জন, যা ব্যাংকের নিয়ম-নীতি না মেনে ২০২০ সালে ২০ হাজার ৮০৯-এ তুলে আনা হয়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে ‘অবৈধ দখলদার’ এস আলম গ্রুপকে ইসলামী ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে ভেঙে দেওয়া হয় ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। একই সঙ্গে গঠন করা হয় স্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ। পরে ২০ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছিলেন, ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।


মন্তব্য