ভুয়া সংবাদের নেপথ্যে দেশ জুড়ে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা
- বিশেষ প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০৭:০১ PM , আপডেট: ০৪ জুন ২০২৫, ০৮:১০ PM

বিশেষ প্রতিনিধি:
মিথ্যা, গুজব ও অপতথ্য ছড়িয়ে পুরো দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পায়তারা চালিয়েছে সমকালসহ আরো কতিপয় গণমাধ্যম। মূলত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) একটি অধ্যাদেশ জারী হওয়ার পর মিথ্যা সংবাদ দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে উঠেপড়ে লাগে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট, যার নেতৃতে দেয় ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়া আওয়ামী ব্যবসায়ী একে আজাদের মালিকানাধীন হামিম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান দৈনিক সমকাল'র সাংবাদিক আবু সালেহ রনি। চাউর আছে ৫ আগস্ট পরবর্তী প্রেক্ষাপটে প্রায় বিলীন হওয়া আওয়ামী লীগের হাল ধরতে একে আজাাদের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
জানা গেছে, গতকাল ৩ জুন মঙ্গলবার রাতে 'অন্তর্বর্তীকালীন' সরকার 'জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন’ সংশোধন করে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের পরিচয়, বা মর্যাদা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে, একটি অধ্যাদেশ জারি করে। এ অধ্যাদেশের ফলে অকারণে, ভুল বোঝাবুঝি থেকে সমালোচনার আগে যা ভাবা জরুরি, সেটা হচ্ছে- এ সংশোধনীতে ‘সহযোগী’ শব্দের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অংশগ্রহণকারীদের পরিধি সম্প্রসারিত হয়েছে। এতোদিন যারা আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পাননি, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সহায়ক ছিলেন, তারা এখন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবেন। একইসঙ্গে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি আগের তুলনায় আরও সুসংহতভাবে সংজ্ঞায়িত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কাজও আইনি ভিত্তি পাচ্ছে।
অথচ সমকালসহ আরো কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানসহ চার শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে।
তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম তা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, "মুজিবনগর সরকারে যারা ছিলেন, তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তবে মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে বিবেচিত হবেন।"
"বিদেশে এবং দেশের অভ্যন্তরে যারা সহযোগিতা করেছেন, কাজ করেছেন, যারা সশস্ত্র ছিলেন না, তারাও মুক্তিযোদ্ধা। তারা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত হবেন। মুজিবনগর সরকারে যারা যুক্ত ছিলেন। তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা।"
তিনি বলেন, "মুজিবনগর সরকার পুরো যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। এটা ঐতিহাসিক সত্য। ইতিহাস পরিবর্তন করা যায় না। মুজিবনগর সরকারকে ‘সহযোগী’ বলা হয়নি। ওই সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন।"
সমকালের এমন আজগুবি ও মিথ্যা সংবাদের রেশ ধরে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টির পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে প্রকৃত ঘটনা জানানো হয়। এ ধরনের মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করলে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান উইংয়ের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ তালুকদার। একই সময়ে ফ্যাক্ট চেকিং সহ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছেন সমকাল যে হেডলাইন দিয়েছে সেটা মিথ্যা।
এদিকে আজ সকালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মো. মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন। তিনি বলেন, ‘মুজিনগর সরকারের মধ্যে কে ছিলেন; শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মো. মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও খন্দকার মোশতাক সাহেব ছিলেন। তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা।’
কিন্তু সমকালের সাংবাদিক আবু সালেহ রনি সিন্ডিকেট নিউজ করে শেখ মুজিব, জাতীয় চার নেতাদের মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে। মুহুর্তে তা ভাইরাল হয়ে সারাদেশে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়।
মূলত এ সিন্ডিকেট চেয়েছিল সরকার জাতীয় চার নেতাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি বাতিল করে প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করছে' এমন একটি ন্যারেটিভ দাড় করিয়ে দেশের মানুষকে সংক্ষুব্ধ করে তুলতে। যাতে একটি ভয়ংকর গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া যায়। কারণ, আওয়ামী লীগ বাদ দিলেও শেখ মুজিব ও জাতীয় চার নেতার ইস্যুতে শত শত মুজিব অন্ত:প্রাণ নেতাকর্মী রাস্তায় নেমে আসলে নিশ্চিত একটি অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এই ষড়যন্ত্র থেকেই ভুয়া নিউজটি করা হয়েছে বলে বাংলাকন্ঠের অনুসন্ধানে তথ্য উঠে এসেছে।
সংশোধিত অধ্যাদেশে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের’ জন্য পাঁচটি শ্রেণি ঠিক করা হয়েছে। প্রথমত, যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন এবং যেসব বাংলাদেশি বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত, মুজিবনগর সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ (জাতীয় পরিষদের সদস্য) বা এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য), যাঁরা পরবর্তী সময়ে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। চতুর্থত, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক। পঞ্চমত, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
কে এই আবু সালেহ রনি?
আবু সালেহ রনি প্রতিনিয়ত গণহত্যাকারীদের পক্ষে কথা যাচ্ছেন। তার ফেইসবুক স্টাটাস ও পোস্ট তা সাক্ষ্য বহন করে। তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে। এছাড়া তিনি অন্তবর্তী সরকারকে বর্গী সরকার ও ছাত্র উপদেষ্টাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। শুধু তাই নয়, ৫ আগস্টের পর থেকে একজন আওয়ামী লীগের কর্মীর মতো ফেসবুকিং করে যাচ্ছেন এই আবু সালেহ রনি। প্রতিনিয়ত গণহত্যাকারীদের পক্ষে কথা বলে যাচ্ছেন। আবু সালেহ রনির বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ রয়েছে, তিনি ছাত্র উপদেষ্টাদের বাছুর উপদেষ্টা বলে অন্তর্বর্তী সরকারকে বর্গী সরকার বলেন এবং মাঝে মধ্যে আশপাশের সহকর্মীদের ডিস্টার্ব করতে জয় বাংলা বলে ওঠেন অফিসে।
সমকাল ও আবু সালেহ রনির এমন রাষ্ট্রবিরোধী গুজব নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বইছে সমালোচনার ঝড়। নেটিজেনরা কথিত সাংবাদিক আবু সালেহ রনিকে দ্রুত গ্রেফতার করে জিঞ্জাসাবাদের দাবি জানান।
তারা বলছেন, স্বজন হারানোর বেদনায় ঢাকার যে ক'জন সংবাদকর্মী প্রতিনিয়ত ছটফট করছেন সমকালের আবু সালেহ রনি তাদের মধ্যে একজন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী কল্পকাহিনী, ভারতীয় স্ক্রিপ্টকে অনুসন্ধান হিসেবে মাঝেমধ্যেই চালিয়ে দেন। প্রতিবছর টার্গেট করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সমকালে সত্য-মিথ্যা সহ সাইফাই গল্প লিখে পেয়ে আসছিলেন পুরস্কারও।
তার একজন সহকর্মীর ভাষ্য, এ বছর পুরস্কার মিলবে কী না সেটা নিয়ে জনাব রনি ইতোমধ্যে অফিসে সংশয় প্রকাশ করেছেন। ক্ষোভ ছাত্র-জনতা, বিএনপি-জামায়াতের ওপর।
জুলাই আন্দোলনের পর ফেসবুকে অকথ্য ভাষায় লিখে যাচ্ছেন। সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ওরফে পাগলা মানিকের ঘনিষ্ঠজন হওয়ার সুবাদে তার মধ্যে অভিন্ন আচরণ বিস্তার করেছে কীনা সন্দেহ আছে।
সাংবাদিকরা যেহেতু প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বা সরকারি চাকরিজীবী নন, রাজনৈতিক সমালোচনা/সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখার অধিকার তাদেরও রয়েছে। কিন্তু খুনী, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ভুলণ্ঠিত করা ফ্যাসিবাদ সরকারের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে পেশাকে অপব্যবহার করা চরম অন্যায়; ফৌজদারি অপরাধ।
শেখ মুজিবুর রহমানসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের পদক নিয়ে তিনি সমকালে বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন।