এনবিআরের শাটডাউন
বন্দরে বন্দরে অচলাবস্থা

আন্দোলনের দুই মাসের মাথায় অস্থির হয়ে পড়েছে দেশের রাজস্ব প্রধান অন্যতম প্রধান খাত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আন্দোলনরতদের টানা শাটডাউন কর্মসূচির ৩য় দিনে কার্যত দেশের সব বন্দরে বন্দরে অচল অবস্থা দেখা দিয়েছে। ফলে সরকারেরর রাজস্ব আদায়ের চাকা একদম থেমে গেছে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি আজও চলছে। দ্বিতীয় দিনের মত চলা কর্মসূচির কারণে বন্ধ ছিল ঢাকা কাস্টমস হাউসসহ দেশের সব কাস্টমস হাউস ও শুল্ক স্টেশন। এতে সারাদেশের সব বন্দরে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার রোধ ও চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। দ্বিতীয় দিনের মতো আজ রোববার সকালে ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি শুরু করেন আন্দোলনরত কর্মকর্তা–কর্মচারীরা। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে চলছে এই আন্দোলন।
এদিকে আজ দুপুরের দিকে এনবিআর সূত্রে জানানো হয়, অচলাবস্থা নিরসনে আজ রোববার বিকেল ৪টায় অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবেন এনবিআরের আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
পরে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, এনবিআর আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন না অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তবে তিনি বলেন, ‘কর্মকর্তারা শাটডাউন কর্মসূচি পালন করতে চাইলে করুক।’
এদিকে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন অর্থ উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।
সারাদেশের বন্দরগুলোর কেমন অবস্থা রয়েছে- এ নিয়ে বাংলাকন্ঠের বিশেষ আয়োজন..
চট্টগ্রাম বন্দর কাস্টমসে ঝুলছে তালা
শাটডাউন কর্মসূচির কারণে বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ। এর ফলে ৩ হাজার ৬৮০ একক কনটেইনার পণ্য রপ্তানি করা যায়নি। তিনটি জাহাজে এসব পণ্য রপ্তানি করার কথা ছিল।
বেসরকারি কনটেইনার ডিপো সমিতির মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, ‘কাস্টমস কর্মকর্তারা না আসায় ডিপোতে শুল্কায়ন কার্যক্রম হচ্ছে না। এজন্য কোনো কনটেইনার বন্দরে পাঠানো যাচ্ছে না।’
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল আলম জুয়েল বলেন, ‘রপ্তানি পণ্য প্রথমে কারখানা থেকে চট্টগ্রামের ১৯টি ডিপোতে আনা হয়। সেখানে শুল্কায়নের পর কনটেইনারে রাখা হয় সব পণ্য। পরে বুকিং অনুযায়ী বন্দরে এনে জাহাজে তুলে দেওয়া হয় রপ্তানি পণ্যবোঝাই কনটেইনার।’
‘এএস সিসিলিয়া’ জাহাজটি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক জাহাজ কোম্পানি মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানির। এই প্রতিষ্ঠানটির হেড অব অপারেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস আজমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, ডিপো থেকে রপ্তানি কনটেইনার আসতে না পারায় জাহাজটি বন্দর ছেড়ে যেতে পারেনি। একইভাবে বন্দর ছাড়তে পারেনি আরও দুইটি জাহাজ।’
আখাউড়া স্থলবন্দরে স্থবিরতা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কমপ্লিট ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে ব্রহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। আজ রোববার সকাল থেকে বন্দর দিয়ে ভারতে কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি৷ এছড়া বন্ধ রয়েছে পণ্য আমদানিও।
স্থল শুল্কস্টেশন সূত্রে জানা গেছে, কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির কারণে গতকাল শনিবার থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য বিল অব এক্সপোর্ট ও বিল অব এন্ট্রি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এর ফলে বন্ধ রয়েছে পণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্ক্রম। যদিও আগেরদিন বিল অব এক্সপোর্ট করে করে রাখার কারণে গতকাল শনিবার বন্দর দিয়ে ৩ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়। এছাড়া গত ২১ জুন থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত বন্দর দিয়ে ভারতে রপ্তানি হয় প্রায় ৮ কোটি টাকার পণ্য। তবে এ সময়ে ভারত থেকে কোনো পণ্য আমদানি হয়নি।
আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, যাত্রী পারাপার কার্যক্রম কর্মবিরতি কর্মসূচির আওতামুক্ত। তবে যেহেতু বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি অনিয়মিত সেজন্য আমদানি বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়ছে না। এছাড়া রোববার ভারতে সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় এদিন বন্দর দিয়ে খুব বেশি পণ্য রপ্তানি হয় না৷ তাই, আজকে বন্দরে রপ্তানির কোনো পণ্যবাহী ট্রাক আসেনি।
স্থবির বেনাপোল কাস্টমসের কার্যক্রম
কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে বেনাপোল স্থলবন্দরের কার্যক্রম। ফলে পণ্য শুল্কায়ন, পরীক্ষণ ও লোড আনলোড বন্ধ রয়েছে। সকাল থেকে সব ধরে প্রকার আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে।
কমপ্লিট শাটডাউন পালনের জন্য কাস্টম হাউস গেটে ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ না করাই বন্দরে পণ্যজট দেখা দিচ্ছে। বেনাপোল এর বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে বাংলাদেশের প্রবেশের অপেক্ষায় ৮০০টি পণ্যবোঝাই ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে।
আগে যখন অর্ধদিবস কর্মবিরতি ছিল তখন অর্ধ দিবস কাস্টমস ও বন্দরে কাজ হচ্ছিল আর এখন টোটালেই বন্ধ। আজ সকালে বন্দরের শ্রমিকরা কাজে এসে সবাই দুপুরের দিকে বাড়ি চলে গেছে।
বেনাপোল কাস্টমস হাউজের চেকপোস্ট কার্গো শাখার রাজস্ব অফিসার আবু তাহের বলেন, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা কমপ্লিট শাটডাউনের কারণে সকাল থেকে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে
বন্ধ সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর
এনবিআর কর্মচারীদের শাটডাউন কর্মসূচির ফলে বন্ধ রয়েছে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর। ফলে দুদিনে প্রায় দুই কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে সরকার।
কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে ভোমরা বন্দরে রাজস্ব কর্মকর্তাদের অধিকাংশই অফিসে অনুপস্থিত ছিল।
এ সময় ভারত থেকে কোন ট্রাক যেমন বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি; কোনো মালবাহী বাহন ভারতে যেতে পারেনি।
ভোমরা স্থল বন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, প্রতিদিন দুই দেশের মধ্যে প্রায় ১০০ থেকে ১২০টি ট্রাক যাতায়াত করে। সেখান থেকে কমবেশি প্রায় এক কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়। তবে চলমান ধর্মঘটের কারণে গত দু’দিনে কোনো ট্রাক চলাচল করেনি।
ভোমরা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, দু’দেশের পাসপোর্টধারী যাত্রীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ইমিগ্রেশন বিভাগ খোলা ছিল।
এদিকে সরেজমিন পরিদর্শনে যাওয়া গণমাধ্যমকর্মীরা সকাল ১০টার পরপরই ভোমরা বন্দরে যে রাজস্ব বিভাগের অধিকাংশ কর্মকর্তা কর্মচারীর কর্মস্থলে অনুপস্থিত দেখতে পান।
বুড়িমারী স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ
লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারী স্থল শুল্ক স্টেশন (কাস্টমস) বন্ধ রয়েছে। এতে এই স্থলবন্দরের ওপর নির্ভরশীল ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা পড়েছেন ক্ষতির মুখে।
আজ রোববার বুড়িমারী স্থলবন্দরের কাস্টমস ও বন্দরের কার্যালয়গুলোতে শুনশান নিরবতা এবং কর্মব্যস্ত এ বন্দরটি পড়ে রয়েছে একদম ফাঁকা অবস্থায়। এ স্থলবন্দরের বিপরীতে ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা স্থলবন্দরে বহু পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশের অপেক্ষোয় পড়ে আছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। আটকে পড়া গাড়ির যন্ত্রাংশ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন শত শত ব্যবসায়ী। আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় মোটা অংকের লোকসানের আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বুড়িমারী স্থলবন্দরের পণ্য খালাস ও বোঝাইয়ের কাজে নিয়োজিত শ্রমিক মইদুল ইসলাম জানান, ‘কাস্টমের লোকজন কোনো কাজ করছেনা, এজন্য গাড়িও আসছে না। বন্দরে কাজের অপেক্ষায় বসে আছি। কাজ না করলে সংসার চালাবো কিভাবে?’
এ ব্যাপারে বুড়িমারী স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফারুক হোসেন বলেন, ‘দুইদিন ধরে কমপ্লিট শাটডাউন চলছে, কর্যক্রম বন্ধ আছে। আমদানি-রপ্তানি ও সিঅ্যান্ডএফের কাজকর্ম বন্ধ আছে। অবশ্যই ক্ষতি এটা। আমরা চাই দ্রুত সমাধান হউক।’
এ বিষয়ে বুড়িমারী স্থল শুল্ক স্টেশনের সহকারী কমিশার (এসি) রাহাত হোসেন বলেন, ‘পূর্বঘোষিত কর্মসূচির কারণে শুল্কায়ন পুরোদমে বন্ধ থাকায় আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে না। কর্মসূচি প্রত্যাহার হলে পূর্বের মত কার্যক্রম চলবে।’
হিলি স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাডডাউনে’র প্রথম দিনে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরে সীমিত পরিসরে আমদানি চালু থাকলেও আজ রোববার দ্বিতীয় দিন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এতে লোকসানের আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। আজ রোববার সকাল থেকে অফিস খোলা থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপস্থিতি চোখে পড়েনি। অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চেয়ারগুলো ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রাজস্ব কর্মকর্তা জানান, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা কমপ্লিট শাটডাউনে একাত্মতা ঘোষণা করে এখানে সেই কর্মসূচি চলছে। দুই চারজন কর্মকর্তা-কর্মচারী সকালে অফিসে এসে আবার চলেও গেছে। কাস্টমসের সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
হিলি কাস্টমস সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফেরদৌস রহমান জানান, কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউনের’ প্রথম দিন ৩৫ ট্রাকে করে পণ্য আমদানি হয়েছে। কিন্তু কাস্টমস শুল্কায়ন ও পরীক্ষণ না করায় সেগুলো খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। ফলে আমদানি-রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
গত ১২ মে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে বিভক্ত করে অধ্যাদেশ জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর পর থেকে এনবিআর বিলুপ্তি রোধসহ কয়েকটি দাবিতে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন করছেন। গত ২৫ মে অর্থ মন্ত্রণালয় ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অধ্যাদেশটি সংশোধন করার আশ্বাস দিলে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। এর পর ২২ জুন থেকে চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সারাদেশে এনবিআরের কর, মূসক ও শুল্ক দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমপ্লিট শাটডাউন এবং মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি পালন করেন। আজ সোমবারও চলছে কর্মসূচি।