শাহজালালের কার্গো ভিলেজ পুড়ে ছাই

আগুন
  © সংগৃহীত

প্রতি দুই বছর অন্তর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অনুষ্ঠিত হয় অগ্নিনিরাপত্তা মহড়া। কখনও ডামি বিমানে আগুন লাগিয়ে, কখনও হাইজ্যাক বা বোমা হামলার কাল্পনিক দৃশ্য সাজিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সক্ষমতা যাচাই করা হয়। কাগজে-কলমে এসব মহড়ায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ঘটনাস্থলে পৌঁছে ‘সফলভাবে’ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

কিন্তু গতকাল শনিবার বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে লাগা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সেই মহড়ার কার্যকারিতা ও বাস্তব প্রস্তুতিকে বড় প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট, এমনকি রোবট ব্যবহারের পরও এই আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগেছে সাত ঘণ্টা। এতে বিভিন্ন শিল্পকারখানার কোটি কোটি টাকার আমদানি করা কাঁচামাল ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা চোখের সামনে নিজেদের সম্পদ ধ্বংস হতে দেখেছেন, কিন্তু কিছুই করার ছিল না।

শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর সোয়া ২টার দিকে বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটসংলগ্ন কার্গো ভিলেজে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট ওঠানামা স্থগিত করা হয়, যা রাত ৯টার পর থেকে পুনরায় চালু হয়। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রাত ৯টার পর দুবাই থেকে আসা একটি ফ্লাইট শাহজালালে অবতরণ করে।

আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং দায়ীদের চিহ্নিত করতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পাশাপাশি এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগও পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে, তদন্তে নাশকতার প্রমাণ মিললে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিমানবন্দরের যে অংশে আগুন লেগেছে, সেখানে মূলত আমদানি করা পণ্য মজুদ রাখা হতো। আগুনের তীব্রতায় উত্তরাংশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ঘন কালো ধোঁয়া, যা বহু দূর থেকেও দৃশ্যমান ছিল।

আগুনের কারণে বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট ওঠানামা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। ঢাকাগামী বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটকে বিকল্প বিমানবন্দরে অবতরণ করানো হয়।

ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণে একযোগে কাজ করেন। তীব্র তাপ ও বাতাসের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগেছে দীর্ঘ।

রাত সাড়ে ৮টার দিকে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় জানায়, ফায়ার সার্ভিস ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এতে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি, এবং রাত ৯টা থেকে বিমান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।

তবে ঘটনাস্থলে দায়িত্বে থাকা অন্তত ২৫ জন আনসার সদস্যসহ আরও অনেকে আহত হয়েছেন। তাঁদের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও সিএমএইচে ভর্তি করা হয়েছে। আগুনের ঘটনায় নিকুঞ্জ থেকে বিমানবন্দরগামী সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়, চার কিলোমিটারের পথ অতিক্রমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লেগেছে।

ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষতি
এই অগ্নিকাণ্ডে সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। কার্গো ভিলেজের গুদামগুলোতে কোটি কোটি টাকার কাঁচামাল ও মূল্যবান শিল্পপণ্য মজুদ ছিল, যা সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই ঘটনা আমদানি ও রপ্তানি খাতের জন্য বড় ধাক্কা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড়সড় ব্যর্থতা।

এভিয়েশন বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, “আইকাওয়ের এনেক্স-১৭ অনুযায়ী মহড়ার মূল লক্ষ্য হলো বিভিন্ন সংস্থার দ্রুত ও কার্যকর প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবে এই আগুনে সাত ঘণ্টা সময় লাগায় তা ব্যর্থতারই প্রমাণ। শাহজালাল বিমানবন্দর কেপিআইভুক্ত এলাকা—এখানে এমন ঘটনা আমাদের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।”

আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার তৎপরতা
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া অফিসার তালহা বিন জসিম জানান, দুপুর সোয়া ২টার দিকে আগুনের খবর পেয়ে প্রথমে ২৮টি ইউনিট পাঠানো হয়, পরে আরও ৯টি যুক্ত হয়। মোট ৩৭টি ইউনিট সর্বাত্মকভাবে কাজ করে রাত ৯টা ১৮ মিনিটে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনে।

আইএসপিআর জানায়, ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর ফায়ার ইউনিট, মেডিক্যাল ও সহায়ক দল আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেয়। উদ্ধার কাজে বিজিবির দুই প্লাটুনও যুক্ত হয়।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল জানান, ঘটনাস্থল ফায়ার স্টেশন থেকে দুই কিলোমিটার দূরে হওয়ায় প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায় বিকেল ২টা ৫০ মিনিটে। তিনি বলেন, “বাতাসের তীব্রতার কারণে আগুন নেভাতে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। ছোট ছোট ঘরে বিভক্ত অংশে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে।”

ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানান, “এই আগুনে পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন। প্রায় ২৫০টি কারখানার পণ্য পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”

আইএইএবি সভাপতি কবীর আহমেদ বলেন, “এক্সপ্রেস কুরিয়ার ও কার্গো স্টোর পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। এখানে বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে আশঙ্কা করছি।”

ফিকি নির্বাহী পরিচালক টি আই এম নুরুল কবীর বলেন, “এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং ম্যানেজমেন্ট ব্যর্থতা। নিরাপত্তা ও ডিজিটাল মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষতির মাত্রা এত ভয়াবহ।”

ঘটনার সূত্রপাত ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা
প্রত্যক্ষদর্শী ফারুক হোসেন জানান, দুপুর ১টা ৫০ মিনিটের দিকে কার্গো ভিলেজের একটি এসির কাছে আগুন দেখতে পান। তিনি বলেন, “আমি পানির ক্যান নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করি, কিন্তু মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে।”

কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠু জানান, আগুনের সূত্রপাত হয় কুরিয়ার সেকশন থেকে। পাশেই ছিল রাসায়নিকের গুদাম, যা আগুনের বিস্তারে ভূমিকা রাখে।

ফ্লাইট স্থগিত ও পুনরায় চালু
অগ্নিকাণ্ডের পর বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে সব ফ্লাইট স্থগিত করে। এতে ঢাকার আকাশে এবং অন্যান্য বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সন্ধ্যার পর থেকে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং রাত ৯টার পর থেকে ফ্লাইট কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়।

শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম জানান, “ফায়ার সার্ভিস ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় আগুন সম্পূর্ণ নিভে গেছে। রাত ৯টা থেকে ফ্লাইট কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে।”

মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা স্বয়ং বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে পুরো পরিস্থিতি তদারকি করেছেন বলে জানান তিনি।

ফায়ার সার্ভিসের ডিজি বলেন, “বাতাসের তীব্রতা আগুন নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবুও আমাদের সদস্যদের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত আগুন নিভিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এখন অগ্রাধিকার হচ্ছে বিমানবন্দরের পূর্ণ কার্যক্রম সচল রাখা।”


মন্তব্য