সমাবেশ থেকে যে বার্তা দিল জামায়াত
- তানভীর আহমেদ
- প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৫, ১০:২৯ PM , আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৫, ০৮:১৬ PM

সারাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে প্রথমবারের মত রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশে বেশ কিছু বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বিশেষ করে আগামীর সম্ভাব্য নির্বাচনে অর্ন্তবর্তী সরকারের নিকট দলটির বেশ কিছু দাবি-দাওয়া ছাড়া অপর বৃহৎ রাজনৈতিক দল এবং পতিত আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করেও কিছু বার্তা দিয়েছে দলটি।
শনিবার (১৯ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জাতীয় সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামী আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আমরা একটা লড়াই করেছি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। আরেকটা লড়াই হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইনশাআল্লাহ। আমরা দুর্নীতি করব না। জামায়াত থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে কোনো এমপি-মন্ত্রী সরকারি প্লট গ্রহণ করবে না, ট্যাক্সবিহীন গাড়ি চড়বে না, নিজের হাতে টাকা চালাচালি করবে না। কোনো এমপি-মন্ত্রী যদি নির্দিষ্ট কাজের জন্য বরাদ্দ পেয়ে থাকেন কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে দেশের ১৮ কোটি মানুষের কাছে তার প্রতিবেদন তুলে ধরতে বাধ্য থাকবেন।
বক্তব্য দেওয়ার এক পর্যায়ে তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যান। পরে অবশ্য বসে বসে তিনি বক্তব্য দেন। জামায়াত আমির বলেন, চাঁদা আমরা নেব না, দুর্নীতি আমরা করব না। দুর্নীতি আমরা করব না, সহ্যও করব না। এই বাংলাদেশ আমরা দেখতে চাই।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমি বলতে চাই, বাংলাদেশর কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির মুক্তির জন্য আমার লড়াই নয়। রাস্তার একজন পরিচ্ছন্ন কর্মী চা বাগানের একজন শ্রমিক, রক্ত পানি করা ঘাম ঝরানো রিকশা চালক ভাই, মাঠে ময়দানে বাংলাদেশের মানুষের মুখে যারা এক মুঠো ভাত তুলে দিতে চায় আমার সেই কৃষক বন্ধুটি আমি তাদের হয়ে আজকে কথা বলতে এসেছি। আমি কোনো অভিজাত শ্রেণির হয়ে কথা বলতে আসিনি।
বক্তব্যে আবেগপ্রবণ কণ্ঠে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমার আফসোস, যারা ২০২৪ সালে শহীদ হয়েছেন, আমি তাদের সঙ্গে শহীদ হতে পারিনি। আপনাদের কাছে দোয়া চাই- আগামী দিনের ইনসাফভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে আল্লাহ যেন আমাকে শহীদের মর্যাদা দেন।
তিনি আরও বলেন, আমি এখানে জামায়াতের আমির হিসেবে নয়, ১৮ কোটি মানুষের একজন প্রতিনিধি হিসেবে এসেছি। শিশুদের বন্ধু, যুবকদের ভাই, প্রবীণদের সহযোদ্ধা হয়ে এসেছি, এই জাতির মুক্তির প্রত্যয়ে।
তরুণ প্রজন্মকে বিশেষভাবে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, তোমরা শুধু দর্শক হয়ে থাকবে না, এই দেশ গঠনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। এটা শুধু কোনো শ্রেণির যুদ্ধ নয়, এটা চাষি, মজুর, ছাত্র, যুবক—সব শ্রেণির মানুষের যুদ্ধ।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমি কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, এটি আল্লাহর ইচ্ছা। আবার অসুস্থ হয়ে পড়াটাও আল্লাহর পরীক্ষা। যতদিন হায়াত আছে, ততদিনই আমি লড়াই করে যাবো।
ডা. শফিকুর রহমান তার বক্তব্যে ২০২৪ সালে সংঘটিত ‘গণহত্যার’ বিচার দাবি করেন। তিনি বলেন, যে নির্মমতা চালানো হয়েছে, তার বিচার এই দেশের মাটিতেই হতে হবে।
তার আগে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এ দেশে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ডা. তাহের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কী করেছে, বলতে চাই না। তারা গন কেস। তাদের এই দেশে ঢোকার আর কোনো সম্ভাবনা নেই, তারা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে গত ৫৪ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে ‘চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যানের বিপ্লব’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, যারা পুরোনো কায়দায় আবার সেই শাসন ফিরিয়ে আনতে চায়, তাদের আর সুযোগ না দিতে জনগণকে ভেবে দেখার আহ্বানও জানান জামায়াতের এই নেতা।
আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশপন্থীরাই জিতবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত দুটি সমাবেশে (আজ জামায়াতের সমাবেশ ও গত ২৮ জুন ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশ) সেই বার্তা পাওয়া যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘ইনশা আল্লাহ, বাংলাদেশপন্থীরাই জিতবে, চাঁদাবাজবিরোধীরাই জিতবে, সুশাসনের পক্ষের শক্তিই জিতবে।’
জামায়াতের এই নায়েবে আমির বলেন, ‘জামায়াত কোনো সন্ত্রাসবাদকে পছন্দ করে না। ইসলামে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। বাংলাদেশে কোনো জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না, পারবে না, পারবে না। সেটা ধর্মীয় জঙ্গিবাদ হতে পারে, অথবা রাজনৈতিক জঙ্গিবাদ হতে পারে। জামায়াত প্রয়োজনে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, লড়াই-সংগ্রাম করবে।’
চলমান সংস্কারের আলোচনা নিয়ে সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘প্রত্যেকেই বলেন সংস্কার মানি। কিন্তু বৈঠকে বসলে কেউ কেউ “মানি না” ভাব দেখাচ্ছেন। সমস্যাটা কোথায়? সংস্কার তো সবার জন্য কল্যাণের। তাহলে যাঁরা চান না, তাঁদের মতলব আছে! পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতিতে কেন্দ্র দখল হবে না, তাহলে মতলব পূরণ হবে না। পিআর পদ্ধতিতে টাকা দিয়ে ভোট কেনার কোনো সুযোগ নেই, সে জন্য মতলব পূরণ হবে না।’
সংস্কারের আইনগত ভিত্তি কীভাবে দেওয়া হবে, সে প্রসঙ্গে জামায়াতের নেতা এই বলেন, ‘অনেকে বলছেন, আগামী সংসদে দেওয়া হবে। তাহলে আপনারা মনে করছেন, আগামী সংসদে আপনারা জিতবেন, নাকি দখল করবেন? এসব কথা সমাজকে বিভ্রান্ত করবে। জুলাই সনদকে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনগত ভিত্তি দিয়ে যাঁরা জিতবেন, তাঁরা রেটিফাই করবেন। এর ব্যত্যয় জনগণ মানবে না।’
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে গত মে মাসে খালাস পাওয়া জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামও এই সমাবেশে বক্তব্য দেন। তিনি আওয়ামী লীগ আমলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের ফাঁসি দেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানান।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর পদ্ধতি) নির্বাচনসহ সাত দফা দাবিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই সমাবেশের আয়োজন করেছিল জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে সমাবেশে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির মো. নুরুল ইসলাম বুলবুল, ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিনসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই বক্তব্য দেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহতদের কয়েকজন জামায়াতের সমাবেশে অংশ নিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁদের মধ্যে আছেন শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী, শহীদ শাহরিয়ার হাসান আলভীর বাবা আবুল হাসান ও জুলাই চব্বিশ শহীদ পরিবার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক রবিউল আউয়াল। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্রলীগের নির্যাতনে শহীদ আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহও এই সমাবেশে বক্তব্য দেন।
এছাড়াও জামায়াতের এই সমাবেশে অন্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাদের অনেককেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউনুস আহমদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদের, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মহিউদ্দিন রাব্বানি, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুসা বিন ইজহার, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (একাংশ) আমির আবু জাফর কাসেমী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক প্রমুখ।