তারেক রহমান

নির্বাসন থেকে প্রত্যাবর্তনের এক মহানায়ক

তারেক রহমান
তারেক রহমান  © সংগৃহীত

তারেক রহমান। দুই শব্দের এই নামটির সাথে জড়িয়ে আছে এক যুগেরও বেশি সময়ের এক বর্বর নির্যাতনের ইতিহাস। যে ইতিহাসে তাকে বারবার চিত্রায়িত করা হয়েছে একজন দেশদ্রোহী খলনায়ক হিসেবে। প্রধানমন্ত্রী নামক ক্ষমতার উচ্ছাভিলাসী এক ফ্র্যাংকেনস্টাইন ও তার অনুগত কতিপয় বিপথগামী মিলিটারী কর্মকর্তাদের যৌথ প্রযোজনায় রচিত এ ইতিহাস এতটাই নিগূঢ় ছিল যে মনে করা হত এ ঘোর অমানিশা কাটিয়ে কখনো আর ভোর হবে না তার জীবনে। প্রিয় জন্মভূমে ফিরবেন তিনি- এ ধারণা ছিল রীতিমত স্বপ্নাতীত। কিন্তু নিয়তির নিয়মে দীর্ঘ ১৭ বছরেরও বেশি সময় পর নির্বাসিত জীবন শেষে সব ঠিকঠাক থাকলে আগামীকাল বৃহস্পতিবার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে ফিরবেন তারেক রহমান। লাখো জনতা অপেক্ষায় আছেন তাঁকে বরণ করে নিতে। তার এ প্রত্যাবর্তন যেন সত্যিই ফিনিক্স পাখির গল্পের মত এক মহানায়কের আখ্যান।

তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ রাজনীতির বিভক্তি, বিভাজন ও হিংসা মোকাবিলা করা। ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার এখনই সুবর্ণ সুযোগ—এমনটাই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ তাঁদের।

২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নির্যাতনের মুখে দেশ ছাড়েন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এরপর গত সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামলে তাঁর পরিবারের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন।

দেশের গণমাধ্যমে বন্ধ রাখা হয় তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচার। কিন্তু শত ষড়যন্ত্রেও থামিয়ে রাখা যায়নি তাঁকে। যুক্তরাজ্য থেকেই গণতান্ত্রিক দেশের জন্য লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।

তারেক রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর। যদিও ইংল্যান্ডে তার ব্যবসায়িক নথিতে জন্ম সাল ১৯৬৭ সাল উল্লেখ করেছেন তিনি নিজেই। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দম্পতির প্রথম সন্তান।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়, যখন তার পিতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন তারেক রহমান, তার মা ও ভাইসহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়।

সে সময় তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কারাবন্দী হওয়া সর্বকনিষ্ঠদের একজন। ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে তিনি ১৯৮০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তিনি সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হবস, লক, রুশো, ভলতেয়ার, কার্ল মার্কসসহ প্রখ্যাত দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেন। তবে অনার্স পরীক্ষা দেওয়ার আগেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে।

১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের পাতানো নির্বাচনের আগে তারেক রহমান গৃহবন্দিত্ব এড়িয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। এটা ছিল জনসম্মুখে তার প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য। গণমাধ্যমের কাছে তিনি তুলে ধরেন, কীভাবে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করছিল। এর পরপরই জেনারেল এইচ এম এরশাদের স্বৈরাচারী সরকার তার কণ্ঠ রোধ করতে তাকে ও তার মা বেগম খালেদা জিয়াকে একাধিকবার গৃহবন্দী করে।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি তার মায়ের সঙ্গে রাজপথে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৮৮ সালে গাবতলী উপজেলা ইউনিটের সাধারণ সদস্য হিসেবে বিএনপিতে যোগ দেন।

তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনের মাধ্যমে তিনি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং এরশাদ সরকারের পতনে ভূমিকা রাখেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় প্রচারণায় অংশ নেন। ওই নির্বাচনে বিএনপির বিজয়ের মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন।

১৯৬৫ সালে জন্ম নেওয়া তারেক রহমানের বয়স এখন ৬০ বছর। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পরবর্তী রাজনৈতিক উত্থান-পতনের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী ও অংশগ্রহণকারী। বহু প্রতিকূলতা পথ পারি দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি হয়ে ওঠেছেন একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব।

২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি স্থানীয় সমস্যা ও সুশাসন নিয়ে গবেষণার জন্য ঢাকায় একটি কার্যালয় স্থাপন করেন। সেখানে তিনি বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করেন। তার এই উদ্যোগের ফলেই ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। চেয়ারপারসনের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও এবং তৃণমূল থেকে ব্যাপক সমর্থন থাকলেও তিনি কোনো মন্ত্রিত্ব বা সংসদ সদস্যপদ গ্রহণ করেননি। বরং তিনি দলের তৃণমূল শক্তিশালী করার কাজেই মনোযোগ দেন। এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০২ সালে বিএনপির স্থায়ী কমিটি তাকে সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক পদে মনোনীত করে।

২০০৫ সালে তিনি দেশব্যাপী তৃণমূল সম্মেলনের আয়োজন করেন এবং প্রতিটি উপজেলা ইউনিটের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এসব সম্মেলনে তিনি কৃষকদের জন্য সরকারি ভর্তুকি, বয়স্কদের জন্য ভাতা, পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন ব্যাগবিরোধী উদ্যোগ এবং নারী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি কর্মসূচি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। এসব উদ্যোগ স্কুলে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এ সময় তিনি ব্যক্তিগতভাবে সম্মেলনে নিবন্ধন করা অন্তত ১৮ হাজার মানুষের চিঠির জবাব দেন।

২০০৭ সালে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সামরিক শাসন জারি হলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সে সময় দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরকে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিতে বাধ্য করা হয়। একই সময়ে বেগম খালেদা জিয়াকে দেশত্যাগে বাধ্য করার কৌশলের অংশ হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে লন্ডন যেতে হয়।

পরবর্তীতে তারেক রহমানে দেশে ফিরে আমায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। সেনাসমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের তত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আমলে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যে মামলা দায়ের করা হয়। একাধিক মামলায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছিল।

তারেক রহমান বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ২০০৯ সালে। তিনি দেশের অবস্থান করলেও অনলাইনে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন এবংদল পুনর্গঠনের কাজে সক্রিয় হন। ২০১৮ সালে তার মা, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, মিথ্যা মামলায় কারাবন্দী হলে তাকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই থেকে তিনি শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তারেক রহমান ১৯৯৪ সালে সাবেক নৌবাহিনী প্রধান ও দুইবারের মন্ত্রী প্রয়াত রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খানের কন্যা ডা. জোবায়দা রহমানকে বিয়ে করেন। ডা. জোবায়দা রহমান একজন কার্ডিওলজিস্ট এবং তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তাদের একমাত্র কন্যা জাইমা জারনাজ রহমান।


মন্তব্য