কানাডা থেকে ভুলবশত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি, এরপর যা ঘটল

কানাডা
  © ফাইল ছবি

কানাডা থেকে ‘ভুলবশত’ সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী মাহিন শাহরিয়ার। গত পাঁচ মাস ধরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) কর্তৃপক্ষের বন্দিশালায় রয়েছেন।

মাহিন মুক্তির জন্য আইনজীবীর মাধ্যমে কানাডা সরকারের কাছে আবেদন করলেও কোনো সাড়া মেলেনি। বরং আইসিই এক পর্যায়ে তাকে কানাডার সীমান্তে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কানাডা তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর থেকেই তিনি মার্কিন আইসিই পুলিশের হেফাজতেই বন্দি অবস্থায় আছেন।

সম্প্রতি টেলিফোনে কানাডীয় সংবাদমাধ্যম সিটিভি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাহিন দাবি করেন, এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে আজ তার এই অবস্থা। তিনি বলেন, “আমি মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত ছিলাম, কিছুদিন বাড়ির বাইরে থাকতে চাইছিলাম। আমার এক বন্ধু বলল, সে একটা জায়গা জানে এবং সেখানে তার একটি বাড়ি আছে— সেখানে তার বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন থাকলে অবসাদ কেটে যাবে।”

বন্ধুর সেই পরামর্শ মেনে তার দেওয়া ঠিকানার উদ্দেশে রওনা হন মাহিন। ওই ঠিকানাটি ছিল কানাডার মন্ট্রিয়াল প্রদেশে, যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তের কাছে।

টেলিফোনে সিটিভি নিউজকে মাহিন বলেন, “রওনা হওয়ার পর আমি তার (বন্ধু) সঙ্গে নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ রাখছিলাম। কীভাবে, কোন পথ দিয়ে যেতে হবে— সেই পরামর্শ আমাকে দিচ্ছিল সে। ফোনে সে এমনভাবে কথা বলছিল— মনে হচ্ছিল যেন গুগলের জিপিএস ট্র্যাকার তার সামনে খোলা। আমি তার পরামর্শ অনুযায়ী চলতে থাকলাম এবং হঠাৎ এক সময় নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে আবিষ্কার করলাম। সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম, অসাবধানে আমি একটি বড় ভুল করে ফেলেছি।”

“তারপর আমি সীমান্তে টহলরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম এবং আমার অবস্থা ব্যাখ্যা করলাম। আমার ধারণা ছিল, তারা আমাকে কানাডায় ফিরতে সহযোগিতা করবেন; কিন্তু তারা আমাকে কানাডায় ফেরত পাঠানোর পরিবর্তে বন্দিশালায় পাঠাল।”

“পরে আইসিই-এর তরফ থেকে আমাকে বলা হলো, তারা আমাকে কানাডায় ফেরত পাঠাতে চেয়েছিল, কিন্তু কানাডার কর্তৃপক্ষ আমার প্রবেশে আপত্তি জানিয়েছে।”

মাহিনের পক্ষে তাকে কানাডায় ফিরিয়ে আনার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন তার আইনজীবী ওয়াসিম আহমেদ। ওয়াসিম প্রথমে মাহিনকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য কানাডার কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতে আইসিই পুলিশকে অনুরোধ করেছিলেন। সেই অনুরোধের জবাবে গত ১ আগস্ট ওয়াসিমকে পাঠানো এক ইমেইলে আইসিই-র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র মাহিনকে গ্রহণ করার জন্য কানাডীয় কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করবে না।

এরপর কানাডার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ কানাডা বোর্ডার সার্ভিস এজেন্সি (সিবিএসএ)-এর কাছে মাহিনকে ফিরিয়ে আনতে অনুরোধ করেন তিনি। সেই আবেদনের জবাবে সিবিএসএ-এর কর্মকর্তারা বলেন, কানাডায় বসবাসরত কোনো বিদেশি নাগরিক যদি অন্য কোনো দেশে গিয়ে অভিবাসন কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়ে, সেক্ষেত্রে সিবিএসএ-এর কিছু করার নেই।

ফলে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন মাহিন শাহরিয়ার। তার আইনজীবী ওয়াসিম আহমেদ অবশ্য জানিয়েছেন যে এখনই তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কোনো আশঙ্কা নেই।

সিটিভি নিউজকে ওয়াসিম বলেন, “আমরা আইসিই পুলিশকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে মাহিনকে ফেরত পাঠালে মাহিনের জীবন সংশয় ঘটবে। তাছাড়া সে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেনি, এসেছে কানাডা থেকে। তাই আইনগতভাবে তাকে বাংলাদেশে পাঠানো যায় না। মাহিন বাংলাদেশে যেতেও চায় না, কানাডায় ফিরতে চায়— এটাও আইসিই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে।”

“তবে কানাডা যদি একেবারেই ফেরত না নেয়, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে।”

আশা অবশ্য একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। ওয়াসিম জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে সেইফ থার্ড কান্ট্রি এগ্রিমেন্ট নামের একটি চুক্তি আছে। সেই চুক্তির শর্তে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেউ নথিবিহীন ভাবে কানাডায় ঢুকে ধরা পড়লে, কিংবা কানাডা থেকে কোনো নথিবিহীন ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে আটক হলে ১৪ দিনের মধ্যে ওই ব্যক্তিকে কানাডা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠানো হবে।

“আমরা কানাডার ফেডারেল কোর্টে থার্ড কান্ট্রি এগ্রিমেন্ট চুক্তির আওতায় মাহিনকে ফিরিয়ে আনতে আবেদন করেছি। শিগগিরই আবেদনের ওপর শুনানি হবে।”

শুনানিতে ইতিবাচক ফলাল আসবে বলেও আশাবাদী ওয়াসিম। তিনি বলেছেন, “মাহিনের মা ও বোন কানাডায় থাকে। তারা শরণার্থী হিসেবে বসবাসের অনুমতি পেয়েছে। মাহিন এখনও অনুমতি পায়নি, তবে কানাডায় এলে ‘ফার্স্ট ব্লাড’ হিসেবে তার থাকতে সমস্যা হবে না।

মাহিন শাহরিয়ারের বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর ২০১৯ সালে কানাডায় আসে মাহিন, তার মা এবং বোন। কানাডায় আসার পর তারা তিন জনই শরণার্থী হিসেবে বসবাসের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। মা এবং বোনের আবেদন গৃহীত হলেও মাহিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ওয়াসিম জানিয়েছেন, এক প্রতারক পরামর্শকের মাধ্যমে আবেদন করেছিলেন মাহিন। আবেদনপত্রে তথ্যের কারচুপি থাকায় তার প্রাথমিক আবেদন বাতিল হয়। এ ব্যাপারটি নিয়েই তিনি অবসাদের ছিলেন।

কানাডায় পরিবারের খরচ মেটানোর জন্য উবার ট্যাক্সি চালাত মাহিন। তার বোন কানাডার একটি স্কুলে পড়াশোনা করে। তবে মাহিন আটকের পর থেকে তাদের পুরো পরিবার এলোমেলো হয়ে পড়েছে।

সিটিভি নিউজ  ওয়াসিম জানান, “ছেলের চিন্তায় মাহিনের মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে তিনি শয্যাশায়ী। তার বোন জানিয়েছে, পরিবারের খরচ মেটানোর জন্য সে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বর্তমানে হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছে। সে বলেছে, তার পক্ষে আর স্কুলের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”

সূত্র : সিটিভি নিউজ


মন্তব্য