আসছে যুগান্তকারী নীতিমালা: বন্দরে পণ্য খালাসে কমবে ব্যয়

বন্দর
  © ফাইল ছবি

বন্দরে আটকে থাকা আমদানি পণ্যের দ্রুত খালাস নিশ্চিত করতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংস্কার আনতে যাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে আমদানি নীতি আদেশ ও বিএসটিআইয়ের বাধ্যতামূলক মান পরীক্ষাসংক্রান্ত বিধিমালায় সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মতে, গত এক দশক ধরে যেসব পণ্য মানসম্মতভাবে আমদানি হচ্ছে, সেগুলোর জন্য ঝুঁকি নিরুপণ করে দ্রুত ছাড়পত্র প্রদানের নিয়ম চালু করা হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘আমদানি নীতি আদেশ ২০২৪-২০২৭’-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় তিনটি পৃথক চ্যানেল—গ্রিন, ইয়েলো ও রেড—বিস্তৃতভাবে ব্যবহারের প্রস্তাব রয়েছে। গ্রিন চ্যানেলের আওতায় পণ্য বন্দরে পৌঁছানোর পর সরাসরি খালাস করা যাবে। ইয়েলো চ্যানেলে শর্তসাপেক্ষে পরীক্ষার পর ছাড়পত্র মিলবে। আর রেড চ্যানেলের পণ্য বাধ্যতামূলক পরীক্ষার পরই ছাড় দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অধিশাখা) মো. আব্দুর রাজ্জাক এক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “পণ্য দ্রুত ছাড়ের জন্য কিছু বিধি ও আইন সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য বাণিজ্যসচিবের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক হবে। সেখানে বিভিন্ন পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে।”

বর্তমানে আমদানি নীতি আদেশ, ২০২১-২০২৪ অনুসারে ৭৯টি পণ্যের বিএসটিআই অনুমোদন বাধ্যতামূলক। এর মধ্যে ৩২টি খাদ্যপণ্য এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ও রাসায়নিক দ্রব্য রয়েছে। বিএসটিআই সূত্র জানায়, বৈদ্যুতিক পণ্যের পরীক্ষায় সময় বেশি লাগায় অনেক পণ্য মাসের পর মাস বন্দরে পড়ে থাকে, ফলে আমদানিকারকদের বাড়তি খরচ গুনতে হয়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এলইডি লাইট পরীক্ষায় ৯০ কর্মদিবস, ব্যাটারিচালিত পণ্যে ৬০ কর্মদিবস এবং বৈদ্যুতিক লাইটে ২৮ কর্মদিবস সময় লাগে। এই বিলম্ব আমদানিকারকের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বিএসটিআই মহাপরিচালক এস এম ফেরদৌস আলম বলেন, “আমরা বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো সিস্টেম চালুর উদ্যোগ নিচ্ছি। এনবিআর এই ব্যবস্থায় ১৯টি সংস্থাকে একত্রে সমন্বয় করছে। পাশাপাশি, যেসব পণ্যের মান বিগত ১০ বছরে কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি, সেসব ক্ষেত্রে ঝুঁকি বিবেচনায় দ্রুত ছাড়ের অনুমোদন দেওয়া হবে। এ জন্য আইন ও বিধিমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হবে।”

তবে ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতা বলছে, শুধু নীতিমালার সংস্কার নয়; বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আরও জরুরি। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি হাফেজ এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমি ৩০-৪০ বছর ধরে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট আমদানি করছি। তবু আমাদের পণ্য কোনো কারণ ছাড়াই কাস্টমস এক মাস আটকে রেখেছে। শুধু নিয়ম নয়, বাস্তবায়নকারীদের মানসিকতার পরিবর্তনও দরকার।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিএসটিআই সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘অস্থায়ী ছাড়ের ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে, বিশেষ করে বৈদ্যুতিক পণ্যের ক্ষেত্রে। পণ্য আমদানির পর বিএসটিআই পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল না আসা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের গুদামে পণ্য পৌঁছলে সিলগালা করে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তা বাজারজাত করা যায়।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বাণিজ্য সহজীকরণের স্বার্থে বন্দরে সময়মতো পণ্য খালাস এখন জরুরি। অথচ বিএসটিআই পরীক্ষা, কাস্টমস-প্রক্রিয়া ও আমদানি নীতির জটিলতা একত্রে মিলে পণ্যের গতি থামিয়ে দিচ্ছে। সরকার যদি বাস্তবমুখী ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারে, তাহলে পণ্য খালাসে গতি ফিরবে, ব্যবসায়ী পর্যায়ে খরচ কমবে এবং ভোক্তার হাতেও পণ্য পৌঁছাবে তুলনামূলক কম দামে।’


মন্তব্য