বৈদেশিক লেনদেনে বিরাট সুখবর

অর্থনীতি
  © ফাইল ছবি

দীর্ঘ প্রায় এক দশক ধরে চলা বৈদেশিক লেনদেনের অস্বাভাবিক ভারসাম্যহীনতার পর বাংলাদেশে ঘটেছে এক বিশাল অর্থনৈতিক পরিবর্তন। একসময় যেখানে রপ্তানির তুলনায় আমদানি ছিল অনেক বেশি, বৈধ রেমিট্যান্সের স্থান দখল করছিল হুন্ডি, এবং মুদ্রার প্রবাহে হস্তক্ষেপ ঘটাচ্ছিল ইনভয়েসিং কারচুপি। এই জটিল বাস্তবতায় এবার ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে চলতি হিসাব। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত অর্জন করে বাংলাদেশ ফিরেছে বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যের সীমানায়; যেখানে গত দুই অর্থবছর ছিল বিপুল ঘাটতির খাতায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে ৯৮ কোটি ডলার। অথচ এর আগের বছর একই হিসাব ছিল ৬৫১ কোটি ডলার ঘাটতিতে। এরও এক বছর আগে, অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঘাটতির অঙ্ক ছাড়িয়েছিল ১ হাজার ১৬৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরে সেই ঘাটতি পুষিয়ে সরাসরি উদ্বৃত্তে ফেরার ঘটনা দেশের অর্থনৈতিক নীতির মোড় পরিবর্তনের দিকেই ইঙ্গিত করে।

এই অভাবনীয় পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল ঠিক গত বছরের আগস্টে, ছাত্র-জনতার এক সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। পুরোনো সরকার পতনের পর যে অন্তর্বর্তীকালীন শাসনব্যবস্থা গঠিত হয়, তাদের প্রথম অগ্রাধিকার ছিল বহির্বাণিজ্যের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া অর্থ পাচার ও হুন্ডিকে রুখে দেওয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে উৎসাহ এবং বৈধ চ্যানেলে ডলার প্রবাহ নিশ্চিত করার দিকে নজর দেওয়া হয়। ফলাফল হিসেবে অর্থনীতি পেয়েছে এক নতুন মাত্রা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই পরিবর্তন হঠাৎ করে আসেনি। রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরেও একটি মনস্তাত্ত্বিক পালাবদল হয়েছে। অর্থ পাচারের রুট চিহ্নিত করে কঠোর নজরদারি, হুন্ডির উৎসে আঘাত, ইনভয়েসিং জালিয়াতি বন্ধের চেষ্টা, এসবই ছিল সুনির্দিষ্ট কৌশলের অংশ।

নতুন নীতির ছায়ায় শুধু চলতি হিসাব নয়, সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যেও এসেছে পরিষ্কার উন্নতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে সামগ্রিক লেনদেন উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৩২৯ কোটি ডলার, যেখানে আগের বছর ছিল ৪৩০ কোটি ডলারের ঘাটতি। এমনকি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষেও ঘাটতির অঙ্ক ছিল ৮২২ কোটি ডলার।

দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই পটপরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে তিনটি বড় পরিবর্তন: প্রথমত, আমদানি বিল নিয়ন্ত্রণ করে বৈদেশিক ব্যয় সীমিত রাখা হয়েছে; দ্বিতীয়ত, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে এবং তৃতীয়ত, বৈধ পথে ডলার আনার জন্য ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে উৎসাহ ভাতা ও প্রণোদনা কার্যকর রাখা হয়েছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে ৩ হাজার ৩৩ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৬৪১ কোটি ডলার বা ২৬.৮২ শতাংশ বেশি। একই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৫ কোটি ডলারে, যেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ছিল ২ হাজার ৭৩৮ কোটি ডলার।

বিশ্লেষকদের মতে, সামগ্রিকভাবে এখন যে ধারা তৈরি হয়েছে, তা শুধু প্রযুক্তিগত হিসাব নয়, এটি রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির বহিঃপ্রকাশ। বিপর্যস্ত আর্থিক ব্যবস্থাকে একটা সুশৃঙ্খল কাঠামোতে ফিরিয়ে আনা শুধু আর্থিক পুনরুদ্ধার নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতার পুনর্গঠন। তবে এই ধারা ধরে রাখা যাবে কি না, তা নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারকদের দৃঢ়তা ও টেকসই পরিকল্পনার ওপর।


মন্তব্য