৩৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে ২৯৯ কোটি টাকা কর মাফের কেরামতি

এনবিআর
  © সংগৃহীত

মাত্র ৩৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে রাষ্ট্রের ২৬৬ কোটি টাকার প্রযোজ্য আয়করকে ৩৩ কোটি টাকাতে নামিয়ে আনার এক মহা কেরামতি দেখিয়েছেন দুই কর কর্মকর্তা। বিনিময়ে একজন ভাগিয়েছেন নিজের পদোন্নতি। শুধু কি তাই? ঘুষকে জায়েজ করতে ট্রাইব্যুনালের আদেশ অমান্য, একজনের অর্ডারশীট আরেকজনকে দিয়ে তৈরি, কর নির্ধারণে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমোদন না নিয়ে মাত্র দুইদিনে সব কাজ শেষসহ সব জালিয়াতিই করেছেন ওই দুই কর্মকর্তা। এ ঘটনায় একজনের শাস্তি হলেও আরেকজন এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর)।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, কর অঞ্চল-১৮, ঢাকার আওতাধীন করদাতা প্রতিষ্ঠান জোবাইদা করিম জুট মিলস লিমিটেড নামের পাটজাত পণ্য রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানটির দুই করবর্ষের ২৯৯ কোটি টাকার কর নির্ধারণ করা হয়। এ নিয়ে  প্রতিষ্ঠানটি ট্যাক্সেস আপীলাত ট্রাইব্যুনালে গেলে ট্রাইব্যুনাল কর রিভাইজ করার নির্দেশনা দিয়ে ওই কর অঞ্চলে প্রেরণ করে। সেখানে দায়িত্বরত উপ কমিশনার ( ডিসিটি) মো. জাহাঙ্গীর আলম সংশ্লিষ্ট সার্কেল কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি করিম গ্রুপের ২৯৯ কোটি টাকার করকে কমিয়ে মাত্র ৩৩ কোটি টাকায় নামিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। এতে করিম গ্রুপ ডিসিটি জাহাঙ্গীর আলমকে ৩০ লাখ টাকা ঘুষের প্রস্তাব দেন। জাহাঙ্গীর কর কমানোর পথ খুঁজতে থাকেন।

এরই মধ্যে চলতি বছরের ৭ জুলাই জাহাঙ্গীর আলম যুগ্ম কর কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে যান। এ সময়ের মধ্যে তিনি ইএসিটি মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে বিষয়টি নিয়ে ম্যানেজ করেন। নতুন কর অঞ্চলে যোগদান করতে হবে-এই অজুহাতে তড়িঘড়ি করে মাসুদুর রহমানকে দিয়ে অর্ডারশীট তৈরি করান। যদিও একজনের অর্ডারশীট অন্যজন তৈরি করা আইন বর্হিভূত কাজ। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা অমান্য করে রিভাইজ না করে উল্টো জাহাঙ্গীর আলম কোম্পানির সঙ্গে ঘুষের দফারফা করে ২৯৯ কোটি টাকার কর ৩৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করেন। কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিনি ওই কর অঞ্চলের রেঞ্জ বা কমিশনারের অনুমোদন নেননি। মাসুদকে দিয়ে অর্ডারশীট তৈরি করে মাত্র দুইদিনের মধ্যে রেঞ্জ বা কমিশনারের অনুমোদন ছাড়াই ব্যাক ডেডে সই করে কোম্পানিকে ২৬৬ কোটি টাকার কর কমিয়ে দেন। এ কাজে সহায়তা করায় ইএসিটি মাসুদুর রহমানকেও ৫ লাখ টাকা ঘুষ দেন। 

এদিকে বিষয়টি এনবিআরের কর অঞ্চল-১৮, ঢাকার রেঞ্জ ও কমিশনারের নজরে আসলে করদাতা কোম্পানির ফাইল এনবিআরে নিয়ে আসা হয়। যাচাই শেষে ঘুষের বিনিময়ে ২৬৬ কোটি টাকার কর কমিয়ে দেওয়া, ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা অমান্য, একজনের অর্ডারশীট আরেকজন তৈরি এবং রেঞ্জ ও কমিশনারের অনুমোদন না নেয়ার অভিযোগের সত্যতা পায় এনবিআর। পরে যুগ্ম কর কমিশনার মো. জাহাঙ্গীর আলম ও অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে ঘুষের বিনিময়ে অনিয়ম ও কর কমিয়ে দেওয়ার বিষয়টির সত্যতা মেলে। যদিও মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান ঘুষ নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি জানিয়েছেন, মো. জাহাঙ্গীর আলমের অনুরোধে তিনি অর্ডারশীট তৈরি করেছেন। তিনি কিছুই জানেন না। জাহাঙ্গীর তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন।

কিন্তু এনবিআরের তদন্তে দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৩৫ লাখ টাকার ঘুষের বিনিময়ে ২৬৬ কোটি টাকার কর কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ প্রমান হওয়ায় ইএসিটি মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই অপরাধের মাষ্টারমাইন্ড যুগ্ম কর কমিশনার মো. জাহাঙ্গীর আলমকে শাস্তি হিসেবে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। 

সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান স্বাক্ষরিত জারি করা পৃথক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কর অঞ্চল-১৬, ঢাকার যুগ্ম কর কমিশনার (বর্তমানে কর অঞ্চল নোয়াখালীর পরিদর্শী রেঞ্জ-৩) মো. জাহাঙ্গীর আলম এর চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। সরকার জনস্বার্থে তাঁকে সরকারি চাকরি হতে অবসর প্রদান করা প্রয়োজন মর্মে বিবেচনা করে। সেজন্য সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তাঁকে সরকারি চাকরি হতে অবসর প্রদান করা হলো।

এদিকে, ইএসিটি মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান এর সাময়িক বরখাস্তের আদেশে বলা হয়েছে, কর অঞ্চল ফরিদপুরের অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি সংক্রান্ত কাজে সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছেন। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সেজন্য মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ১২ অনুযায়ী চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। বরখাস্তকালীন তিনি বিধি মোতাবেক খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন।

এছাড়াও মো. জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে এর আগেও রাজস্বের ক্ষতি করে ঘুষ নেয়াসহ নানান ধরনের অভিযোগ রয়েছে। অত্যন্ত গোপনে ও বদলির সুবাদে তড়িঘড়ি করে কোম্পানি থেকে ঘুষ নিয়ে রাষ্ট্রের ২৬৬ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির চেষ্টা করেছেন।

এনবিআর সূত্রমতে, মো. জাহাঙ্গীর আলম উপকর কমিশনার হিসেবে বিভাগীয় পদোন্নতিপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা। তিনি ২০২৪ সালের ২১ অক্টোবর কর অঞ্চল-১, চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে কর অঞ্চল-১৮, ঢাকায় উপকর কমিশনার হিসেবে যোগদান করেন। চলতি বছরের ৭ জুলাই উপকর কমিশনার হতে যুগ্ম কর কমিশনার হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। ১০ জুলাই কর অঞ্চল-১৮, ঢাকা হতে কর অঞ্চল-১৬, ঢাকায় পরিদর্শী রেঞ্জ-৪ তাকে বদলি করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর তাকে কর অঞ্চল নোয়াখালীর পরিদর্শী রেঞ্জ-৩ বদলি করা হয়। আর ইএসিটি মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে চলতি বছরের ২০ আগস্ট কর অঞ্চল-১৮, ঢাকা থেকে কর অঞ্চল ফরিদপুরে বদলি করা হয়। যদিও এ ঘটনায় কর কমানো ও অনিয়মে জড়িত করিম গ্রুপের জোবাইদা করিম জুট মিলস লিমিটেডের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।


মন্তব্য